- ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে উৎকৃষ্ট মানের রেশমের জন্য বিখ্যাত, সিল্ক সিটি নামে পরিচিত রাজশাহী।
- আগে বেঙ্গল সিল্ক বা গঙ্গা সিল্ক নামে পরিচিত ছিল এ অঞ্চলের রেশম। ব্যবসার সম্ভাবনা দেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রাজশাহীতে একটি রেশম কারখানা স্থাপন করে। ১৯৭৮ সালে এটি হস্তান্তর করা হয় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের (বিএসডিবি) কাছে।
- আশপাশের জেলার কৃষকরা উৎকৃষ্ট মানের রেশম সুতা উৎপাদনে দক্ষ ছিলেন বলেই রাজশাহীর রেশম শিল্প প্রসারিত হয়েছিল। রেশম পোকাকে কাঁচা তুঁত পাতা খাইয়ে উচ্চমানের রেশম তৈরি করতেন তারা। এই রেশম সুতা বিলাসবহুল পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। এখানে তিন ধরনের রেশম উৎপাদিত হয়— তুঁত, এন্ডি ও তসর। এর মধ্যে তুঁত রেশম সবচেয়ে ভালো ও দামি।
- তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা সংকটের মুখে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর রেশম শিল্প। আমদানিকৃত কম দামের সুতার ওপর নির্ভরশীলতা, বিখ্যাত এ রেশম শিল্পের সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া সম্প্রতি অনিয়মিত আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা সংকটের মুখে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর রেশম শিল্প। আমদানিকৃত কম দামের সুতার ওপর নির্ভরশীলতা, বিখ্যাত এ রেশম শিল্পের সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া সম্প্রতি অনিয়মিত আবহাওয়া পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে। অনিয়মিত আবহাওয়ার প্রভাবে স্থানীয় তুঁত ও রেশম পোকা উৎপাদনকারীরা, উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ সমস্ত কারণে হ্রাস পাচ্ছে রেশম উৎপাদনের হার।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং রেশমপোকা পালনের প্রচলিত পদ্ধতিই রেশম পোকায় ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আক্রমণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। সেইসঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে রেশম উৎপাদকদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে।
গবেষণার সহ-লেখক কামরুল আহসান জানান, Bombyx mori L প্রাকৃতিক রেশম আঁশ তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোকা। পরিবেশের প্রভাব সরাসরি এর বৃদ্ধি ও বিকাশে পড়ে। এই পোকার ওপর নানা রোগ ও পোকামাকড়েরও আক্রমণ হয়। ফলে পোকাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই সংক্রমিত হয়।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বছরে চারটি মৌসুমে রেশমপোকা পালন করেন উৎপাদনকারীরা। এই মৌসুমগুলো হলো— ভাদ্র (আগস্ট-সেপ্টেম্বর), অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর), চৈত্র (মার্চ-এপ্রিল) এবং জ্যৈষ্ঠ (মে-জুন)।
এর মধ্যে জ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা চরমে পৌঁছায়। ফলে রেশম পোকার গড় উৎপাদন প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশে গ্রীষ্ম মৌসুম সাধারণত এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
ভালো মানের সুতা উৎপাদন ও লার্ভার সঠিক বৃদ্ধির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো, প্রায় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এর সঙ্গে প্রয়োজন উপযুক্ত আর্দ্রতা।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলে গরমের সময় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭৭-৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত থাকে। ঠান্ডার সময় তাপমাত্রা নেমে যায় ৯-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৪৮-৫৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত। আবার গ্রীষ্মের কোনো কোনো দিনে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)-এরও বেশি হয়। শীতে আবার তা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৪১ ডিগ্রি ফারেনহাইট)-এ নেমে আসে।
অতিরিক্ত গরম ও আর্দ্রতার কারণে রেশমপোকার পরিপাকতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফ্ল্যাচেরি নামক এক ধরনের রোগ দেখা দেয়। একইসঙ্গে নিম্নমানের তুঁত পাতা উৎপাদিত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, পুষ্টিহীন তুঁত পাতায় পর্যাপ্ত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান না থাকায় লার্ভার শরীরে দ্রুত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাকটেরিয়াল ফ্ল্যাচেরি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের (বিএসডিবি) পরিসংখ্যান অনুসারে, এই অঞ্চলে প্রায় ৭০০ কৃষক তুঁত এবং রেশমপোকা উৎপাদনে সরাসরি জড়িত।
রাজশাহীর রেশম চাষি ভাদু শেখ বলেন, “বছরে চারটি মৌসুম থাকলেও অনেক সময় ফসল তুলতে ব্যর্থ হই আমরা। কেউ কেউ আংশিক ফসল তুলতে পারে।”
বিএসডিব‘র ম্যানেজার মোহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, “রোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে একমাত্র উপায় হলো, আক্রান্ত রেশম পোকার মজুদ ধ্বংস করে দেওয়া। কারণ, জীবাণুমুক্ত প্রজনন ও পালন পদ্ধতি ছাড়া রোগ ঠেকানোর নির্দিষ্ট কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই।”
বিএসডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদিত রেশম সুতার পরিমান ছিল ৪০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৭ মেট্রিক টন।

সিল্ক সিটির উত্থান-পতন
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই উৎকৃষ্ট মানের রেশমের জন্য বিখ্যাত রাজশাহী। এ অঞ্চলের কৃষকরা রেশম উৎপাদন করতেন বলে, শহরটির আরেক নাম সিল্ক সিটি।
এই রেশম আগে বেঙ্গল সিল্ক বা গঙ্গা সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। ব্যবসার সম্ভাবনা দেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রাজশাহীতে একটি রেশম কারখানা স্থাপন করে। ১৯৭৮ সালে এটি হস্তান্তর করা হয় বিএসডিবির কাছে। তবে লোকসান বাড়তে থাকায় ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হওয়ার আগে এ কারখানায় বছরে প্রায় ৩০০ টন সুতা উৎপাদিত হতো।
আশপাশের জেলার কৃষকরা উৎকৃষ্ট মানের রেশম সুতা উৎপাদনে দক্ষ ছিলেন বলেই রাজশাহীর রেশম শিল্প প্রসারিত হয়েছিল। রেশম পোকাকে কাঁচা তুঁত পাতা খাইয়ে উচ্চমানের রেশম তৈরি করতেন তারা। এই রেশম সুতা বিলাসবহুল পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।
বর্তমানে রাজশাহীর গড় মানের একটি রেশম শাড়ির দাম প্রায় ৫ হাজার টাকা (৪৬ ডলার) এবং প্রিমিয়াম মানের শাড়ির দাম প্রায় ২০ হাজার টাকা (১৮৫ ডলার) পর্যন্ত হয়।
এখানে তিন ধরনের রেশম উৎপাদিত হয় — তুঁত, এন্ডি ও তসর। এর মধ্যে তুঁত রেশম সবচেয়ে ভালো ও দামি।
১৯৮০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত রেশম কারখানাগুলো দেশীয় সুতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। পরবর্তীতে চীন থেকে আমদানিকৃত সস্তা সুতার প্রভাবে কারখানাগুলো দেশজ উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তখন ১ কেজি দেশীয় সুতার দাম ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা (১১ ডলার), আর চীনা সুতার দাম ছিল মাত্র ৯০০ টাকা (৯ ডলারেরও কম)। ফলে দেশীয় সুতা উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেননি।

সস্তা চীনা সুতায় কাজ করে কারখানাগুলো ভালো লাভ করতে থাকায়, একসময় কারখানার সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে ১০০-এরও বেশি হয়ে যায়।
এরপর, ১৯৯০-এর দশক থেকে চীন ধীরে ধীরে সুতার দাম বাড়াতে থাকে। যেহেতু শিল্প প্রায় পুরোপুরি চীনা সুতার ওপর নির্ভরশীল ছিল, তাই দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করে এ খাতে।
বর্তমানে প্রতি কেজি চীনা সুতার দাম প্রায় ৭ হাজার টাকা (৬৫ ডলার)।
একারণে শিল্পের লাভ ও ক্রেতা দুটোই কমতে থাকে। পণ্যের দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় কমে যায় চাহিদাও। যেখানে ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ১০০ টিরও বেশি কারখানা রেশমজাত পণ্য উৎপাদন করত, সেখানে এখন মাত্র ৪টি কারখানা সচল আছে।
এ বিষয়ে বিএসডিবির কর্মকর্তা হানিফ জানান, সরকার কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে নানা সহায়তা দিয়েছে, রেশম চাষে উৎসাহ জুগিয়েছে, এমনকি চীনা সুতার ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কও আরোপ করেছে। তবুও বর্তমান বিরূপ আবহাওয়ার কারণে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
ব্যানার ছবি: বাংলাদেশের রাজশাহীর একজন রেশম পোকা চাষী। ছবি: মো আবু হানিফ।
সাইটেশন:
- Rashid, M. A., Faroque, O. & Chowdhury, A. K. (2014). Sericulture Industry in Bangladesh: Problems and Prospects. American Journal of Economics. doi:10.5923/j.economics.20140403.02
- Roknouzzaman, M., Mahdi, S. H. A. & Ahsan, M. K. (2016). Disease incidence of silkworm, Bombyx mori L. in different rearing areas and seasons of northern part of Bangladesh. University Journal of Zoology, Rajshahi University. 35:1-6. Retrieved from https://www.researchgate.net/publication/326258871_Disease_incidence_of_silkworm_Bombyx_mori_L_in_different_rearing_areas_and_seasons_of_northern_part_of_Bangladesh
- Rahmathulla, V. K. (2012). Management of Climatic Factors for Successful Silkworm (Bombyx mori L.) Crop and Higher Silk Production: A Review. Psyche: A Journal of Entomology. Volume 2012. Article ID 121234. doi:10.1155/2012/121234
- Nadiruzzaman, M., Rahman, M., Pal, U., Croxton, S., Rashid, M. B., Bahadur, A. & Huq, S. (2021). Impact of Climate Change on Cotton Production in Bangladesh. Sustainability 2021, 13(2), 574; doi:10.3390/su13020574
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল এ, ২০২৩ সালের ২৬ জুন।