- দ্রুতবর্ধনশীল ও খরা-সহনশীল গাছ সজনে চাষের দিকে ঝুঁকছেন বাংলাদেশের কৃষকরা । দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের আদি এই গাছ জলবায়ু ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে একটি নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠছে।
- গবেষকরা বলছেন, সজনে মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। কারণ এর পাতা এবং ফল, উভয়ই পরিপূর্ণ পুষ্টি এবং খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ।
- এছাড়াও তীব্র গরম কিংবা প্রচণ্ড শীত—দুই পরিস্থিতিতেই টিকে থাকতে পারায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, সজনে চাষকে স্মার্ট কৃষির অংশ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।
- বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তা ২০১৭ সাল থেকে সজনে চাষ ও বিপণন নিয়ে কাজ করছেন। তার উদ্যোগে এখন পর্যন্ত দেশের ২০টি জেলার প্রায় ৫ হাজার কৃষক যুক্ত হয়েছেন এই উদ্যোগে।
বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল সজনের বাজারে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে সম্ভাবনাময় এই গাছ এখন শুধু খাবারের উপকরণ হিসেবেই নয়, হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক ও পরিবেশবান্ধব সমাধানও।
খরা-সহনশীল ও দ্রুতবর্ধনশীল গাছ সজনে (Moringa oleifera) দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের আদি উদ্ভিদ। বর্তমানে এটি উষ্ণমণ্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় বহু দেশে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে।
ভরপুর খনিজ উপাদান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, সজনে গাছের পাতা ও ফুল। গবেষকদের মতে, মানবদেহের জন্য বিশেষভাবে উপকারী সজনে পাতা।
বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে সজনে চাষকে ঘিরে শুরু হয়েছে সামাজিক আন্দোলন ও উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ। রাজীব পারভেজ রাজু নামে এক উদ্যোক্তা দেশের ২০টি জেলায় কমিউনিটি ফার্মিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও হোমস্টেড মডেলে অর্থাৎ বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে সজনে চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছেন।

GT Moringa Ltd এর প্রধান নির্বাহী রাজীব পারভেজ রাজু বলেন, “২০০৪ সাল থেকে আমি মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সজনে চাষ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা কতটা বিস্তৃত। ২০১৭ সাল থেকে এ উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত নানাবিধ পণ্য উদ্ভাবনের চেষ্টা করি। অবশেষে ২০২২ সালে, বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়।
তিনি আরও জানান, দেশের ২০টি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার কৃষক এরইমধ্যে সজনে চাষ করছেন। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত পাতা বিক্রি করছেন তারা। তা দিয়ে আবার তৈরি হচ্ছে সজনে গুঁড়ো, কুকিজ ও প্রসাধনী।
অবশ্য সজনে চাষে কৃষকদের মূল আগ্রহ এসেছে, পতিত জমিকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয় করার সুযোগ রয়েছে বলে।
কুষ্টিয়ার খরাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষক মোহাম্মদ আজিম বলেন, “আমি গত পাঁচ বছর ধরে আড়াই একর জমিতে সজনে চাষ করছি। বর্তমানে এখান থেকে বছরে প্রায় ৪ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে।”
তবে দেশের অভ্যন্তরে প্রক্রিয়াজাত সজনে পণ্যের চাহিদা এখনো সীমিত। তাই জিটি মরিঙ্গার লক্ষ্য—পণ্যের গুণমান ও বৈচিত্র্য বজায় রেখে সেগুলোকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়া। কারণ, বিশ্ববাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি।
রাজীব পারভেজ রাজু মঙ্গাবে-কে বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পতিত জমি ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো এবং গুণমান ও বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে বিশ্ববাজারে উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব অর্জন।”


স্বাস্থ্য সচেতনতা ও বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সজনে বাজার
গবেষণায় দেখা গেছে, সজনের পাতায় রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন এ ও সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়ামসহ অগণিত পুষ্টি উপাদান। বৈচিত্র্যময় এই পুষ্টিগুণের কারণে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে ওষুধ, প্রসাধনী, মানব খাদ্য, পশুখাদ্য এমনকি জল পরিশোধনেও।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, ২০২২ সালে বিশ্ব বাজারে সজনে পণ্যের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৯৫০ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলারে। অর্থাৎ প্রতিবছর এর প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বাড়তে থাকা স্বাস্থ্য সচেতনতাই এ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৪২২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন, যাদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বাস করেন। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের দেহে ইনসুলিন পর্যাপ্ত মাত্রায় তৈরি হয় না। সজনেতে থাকা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং প্রাকৃতিকভাবে ইনসুলিন যোগায়। স্বাস্থ্যগত এই উপকারিতার কারণে ইউরোপ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় সজনে-ভিত্তিক পণ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদকরা বাজারে সরবরাহ করছেন সজনে পাতা, তেল, ফল ও পাউডার। এসব উপাদান স্যুপ, তরকারি, স্টু কিংবা সালাদে সচ্ছন্দে ব্যবহার করা যায়।


জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে সজনে
শুষ্ক আবহাওয়াতেও দ্রুত বাড়ে বিধায় সজনে মরুকরণের বিরুদ্ধে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। এর বিস্তৃত শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে রাখে। ফলে শুষ্ক অঞ্চল ও ক্ষয়প্রবণ জমিতে সহজেই এটি চাষ করা যায়।
Global Climate Risk Index অনুযায়ী, গত ২০ বছর ধরে চলমান চরম আবহাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে।
পাশাপাশি, ভারত সীমান্তের কাছাকাছি উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকায় বৃষ্টিপাতের ধরন ও নদীর জলবণ্টনে পরিবর্তনের কারণে খরা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে ।
বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, খরা, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রায় ০ দশমিক ৪ মিলিয়ন হেক্টর (৯ লাখ ৮৮ হাজার একর) পতিত পড়ে আছে।
গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সজনে চাষ হতে পারে স্মার্ট কৃষির অংশ। কারণ এটি প্রচণ্ড তাপ ও শীত উভয়ই সহ্য করতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বলেন, “পতিত জমিতে বেশি করে সজনে লাগানো হলে জমি যেমন কাজে লাগবে, তেমনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।”
Bangladesh Resource Center for Indigenous Knowledge (BARCIK)-এর পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, “খরা বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন প্রচলিত ফসল ব্যর্থ হয়, তখন সজনে হতে পারে সহায়ক বিকল্প। এটি যেমন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তেমনি আর্থিকভাবেও লাভজনক।”
ব্যানার ছবি: সজনে গাছের পাতা তুলছেন একজন কৃষক। ছবি: GT Moringa.
সাইটেশন
Trigo, C., Castelló, M. L., Ortolá, M. D., García-Mares, F. J., & Desamparados Soriano, M. (2020). Moringa oleifera: An unknown crop in developed countries with great potential for industry and adapted to climate change. Foods, 10(1), 31. doi:10.3390/foods10010031
Horn, L., Shakela, N., Mutorwa, M. K., Naomab, E. & Kwaambwa, H. M. (2022). Moringa oleifera as a sustainable climate-smart solution to nutrition, disease prevention, and water treatment challenges: A review. Journal of Agriculture and Food Research. https://doi.org/10.1016/j.jafr.2022.100397
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল – এ, ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি।