- পাটের পরে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থকরী ফসল চা । এর বার্ষিক উৎপাদন ৬০ হাজার টনেরও (৬ কোটি কিলোগ্রাম) বেশি।
- চা বাগানের আগাছা দূর করতে, উৎপাদকরা গ্লাইফোসেট নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। সাধারনত রাউন্ডআপ ব্র্যান্ডের আগাছানাশকটি বেশি ব্যবহৃত হয়। জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবের কারণে এ রাসায়নিক এরইমধ্যে ৩৩টি দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
- কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদদের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ সরকার এখনো এ রাসায়নিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, চা। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে সন্ধ্যার আড্ডায়, এ দেশে চা খুবই জনপ্রিয় পানীয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, জাপান এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও চা সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়গুলোর একটি।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চা উৎপাদন শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৪০ সালে, চট্টগ্রামের পাহাড়ি ঢালে। পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়া এলাকায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান গড়ে ওঠে।
চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে বাণিজ্যিক বাগানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২তম বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী দেশ।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগান আছে, যার মোট আয়তন ১ লাখ ১৩ হাজার ১১২ হেক্টর (২ লাখ ৭৯ হাজার ৫০৬ একর)। এসব চা বাগান থেকে বছরে ৬০ হাজার টনেরও বেশি চা উৎপাদিত হয়।
তবে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চা উৎপাদনে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ বাগানগুলোতে আগাছা ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত গাছপালা দূর করার জন্য অনেক উৎপাদনকারী গ্লাইফোসেট নামের এক ধরনের ক্ষতিকারক আগাছানাশক রাসায়নিক ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশের চা বাগানে কী পরিমানে গ্লাইফোসেট ব্যবহার করা হয় তা জানতে, কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে মঙ্গাবে ।

চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চা শ্রমিক বলেন, “চা বাগানে ঘাস বা আগাছা নষ্ট করার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। স্প্রে করার পর সব ঘাস ১৫ দিনের মধ্যে শুকিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়।”
তার কাছে রাসায়নিকের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম জানতে চাওয়া হলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা ওই শ্রমিক জানান, ওষুধটির নাম রাউন্ডআপ।”
এ ওষুধের মূল উপাদান হলো গ্লাইফোসেট, যেটি এরইমধ্যে বিশ্বের ৩৩টি দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।
রাউন্ডআপ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আগাছানাশক। যেকোনো গাছপালা নষ্ট করতে সক্ষম এ রাসায়নিক। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হতে পারে। কারণ আগাছানাশক পরিবেশে কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত থেকে যায়।
প্রাণীর জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের উপযোগিতা কমিয়ে দেয় আগাছানাশক। পাশাপাশি এর প্রভাবে পরাগায়নকারী পোকা এবং অন্যান্য উপকারী পোকামাকড়ও মারা যায়। এক ফসলী চাষ নিয়ে করা এক বিস্তৃত গবেষণায় দেখা গেছে, আগাছানাশক ব্যবহারে ফসলের বৈচিত্র্য কমে যায়, মাঠে উদ্ভিদ কমে যায় এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়।
বাংলাদেশের মোট ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা বাগানের মধ্যে ১৩৪টি সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলে রয়েছে, লাউয়াছড়া ও রেমা–কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মতো প্রধান রেইন ফরেস্ট। পাশাপাশি, পিগ-টেইলড ম্যাকাউ (Macaca leonine), চশমা-পরা হনুমান (Trachypithecus phayrei), মুখপোড়া হনুমান (Trachypithecus pileatus) এবং উল্লুক (Hoolock hoolock) এর মতো বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে এ অঞ্চলে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ্যা বিভাগের প্রধান রমিজ উদ্দিন বলেন, “সাধারণত বর্ষাকালে আগাছানাশক ব্যবহার করা হয়। তখন মাটি যতটা সম্ভব তা শুষে নেয়। এছাড়া প্রায় সব চা বাগানই উপত্যকায় অবস্থিত। তাই বৃষ্টি হলে এই রাসায়নিক দ্রুত পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং জলজ প্রাণীরও ক্ষতি করে।পাশাপাশি, আগাছানাশক ব্যবহারে পরাগায়নে সাহায্যকারী অনেক উপকারী পোকামাকড় মারা যায়। এক কথায়, পুরো জীববৈচিত্র্য নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের আগাছানাশক ব্যবহারের সঠিক জ্ঞান নেই – এটিই মূল সমস্যা। দেশে প্রায় ২০ বছর আগে, কৃষকরা আগাছানাশক ব্যবহার শুরু করেন। বিশ্বজুড়েই আগাছানাশক ব্যবহৃত হয় কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ শ্রমিক জানেন না, কতটুকু ব্যবহার করা উচিত এবং কত ঘন ঘন এটি ব্যবহার করা যায় বা ঠিক কখন স্প্রে করা উচিত।”


কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামীম আল মামুন বলেন, “২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকার আগাছা দমনের জন্য কয়েকটি আগাছানাশক অনুমোদন করে। এদের বেশিরভাগেরই মূল উপাদান গ্লাইফোসেট। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সরকার এখনো এটি নিষিদ্ধ করেনি।”
তবে সরকার বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “আমরা চা বাগানে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে তারা সঠিকভাবে আগাছানাশক ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণ নিবিড়ভাবে পরিচালনা করার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। তাই রাউন্ডআপ এবং গ্লাইফোসেটভিত্তিক অন্যান্য আগাছানাশক এখনও সারা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত সরকারও এটি নিষিদ্ধ করতে পারছে না।”
গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের কীটনাশকের মতো আগাছানাশকও জমিতে মিশে যায়। যেখানে স্প্রে করা হয় শুধু সেখানেই নয়, অতিরিক্ত স্প্রে করা হলে সেটি ছড়িয়ে আশপাশের গাছপালা ও প্রাণীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। কাছাকাছি থাকা নদী-খাল ও স্থলজ পরিবেশও বৃষ্টির মাধ্যমে এই রাসায়নিকের সংস্পর্শে চলে আসে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, আগাছানাশক বাতাসে উড়ে যেতে পারে বা মাটির কণার সঙ্গে মিশে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।
মূলত, আগাছা দমনের একটি রাসায়নিকবিহীন উপায় হলো, নির্দিষ্ট সময় পরপর আগাছা কেটে ফেলা। কিন্তু এতে শ্রম খরচ বেশি হয়। তাই চা বাগানের মালিকরা পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি উপেক্ষা করে সহজ উপায় হিসেবে আগাছানাশক ব্যবহার করেন।
ব্যানার ছবি: ছানার সঙ্গে একটি মা উল্লুক। সিলেট অঞ্চলে, বাংলাদেশের অধিকাংশ চা বাগানের অবস্থান। এ অঞ্চলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট আছে, যা এই উল্লুকের মতো বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতির আবাসস্থল। ছবি: বালাজি ভেঙ্কটেশ শিবরামকৃষ্ণান via Flickr (CC BY-NC-SA 2.0).
সাইটেশন:
- Brühl, C. A. and Zaller, J. G. (2011). Indirect herbicide effects on biodiversity, ecosystem functions, and interactions with global change. Emerging Issues in Analytical Chemistry. P 231-272. Elsevier. doi:10.1016/B978-0-12-823674-1.00005-5
- Costas-Ferreira, C., Durán, R., & Faro, L. R. (2022). Toxic effects of glyphosate on the nervous system: A systematic review. International Journal of Molecular Sciences, 23(9), 4605. doi:10.3390/ijms23094605
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল – এ, ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি।