- বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আবারও দেখা মিলছে, এশিয়ার বৃহত্তম হরিণ প্রজাতি নীলগাইয়ের। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে প্রাণীটির বিচরণ ছিল। তবে আবাসস্থলের ক্ষতি এবং অনিয়ন্ত্রিত শিকারের কারণে ১৯৩০-এর দশকে, স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় প্রাণীটিকে।
- নীলগাইদের আকস্মিক দেখা মেলা ইঙ্গিত দেয় — এখনও বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এ প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, বিশেষ করে যেসব জায়গায় এখনো প্রাণীটির বসবাস উপযোগী আবাসস্থল রয়েছে।
- ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে অন্তত ১৩ বার নীলগাইকে বাংলাদেশে দেখা গেছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশিবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব খবর প্রকাশিত হয় না। কারণ স্থানীয়রা সাধারণত নীলগাই ধরে ফেলে এবং মাংসের জন্য এদের হত্যা করে।
- বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে নীলগাই ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলে, জনসচেতনতা তৈরির কাজও জরুরি। স্থানীয় মানুষকে নীলগাই শিকারে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং বুঝিয়ে বলতে হবে, কেন এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক গ্রামে এসে হাজির হয়, বিরল এক অতিথি। সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে চলে আসে এশীয় হরিণ প্রজাতির সবচেয়ে বড় সদস্য — নীলগাই। এটি নীল ষাঁড় নামেও পরিচিত।
নীলগাইটিকে দেখতে পেয়েই, ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা তাড়া করে। এক পর্যায়ে গ্রামবাসী প্রাণীটিকে ধরেও ফেলে।
মঙ্গাবে-কে এমনটাই জানিয়েছেন, গ্রামের বাসিন্দা রায়হান আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, “নীলগাই ধরা পড়ার খবর পেয়ে উৎসুক গ্রামবাসী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। শেষ পর্যন্ত তারা প্রাণীটিকে জবাই করে মাংস ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে।”
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গির বাসিন্দা নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে জানা যায়, কয়েক সপ্তাহ আগেই আরেকটি নীলগাই প্রায় একই পরিণতির শিকার হতে যাচ্ছিল। ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ এ সেটিও সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিক থেকে প্রবেশ করেছিল। তবে সৌভাগ্যক্রমে সেটি বেঁচে যায়। নীলগাইটিকে দেখতে পেয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় প্রাণীটিকে আটক করে, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) কিছু সদস্য। পরবর্তীতে তারা প্রাণীটিকে বন বিভাগের হাতে তুলে দেন।
বাংলাদেশে এ দুটি নীলগাই এর ভাগ্য প্রসন্ন না হলেও, দেশের সীমানায় পরপর দুটি নীলগাইয়ের (Boselaphus tragocamelus) দেখা মেলার ঘটনা, প্রজাতিটির ভবিষ্যত সম্পর্কে আশার আলো জাগায়। ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানে (এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোতে এ প্রজাতির দেখা মেলে) নীলগাইয়ের প্রাচুর্যতার কারণে, প্রাণীটিকে IUCN রেড লিস্টে বিশ্বব্যাপী ‘হুমকির মুখে’ বলে বিবেচনা করা হয় না। তবে বাংলাদেশে প্রায় শত বছর আগে, ১৯৩০ এর দশকে নীলগাইকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে নীলগাইয়ের প্রবেশ ঘটেছে অন্তত ১৩ বার। এদের বেশিরভাগই এসেছে ভারতের দিক থেকে। এছাড়া কয়েকটি নেপাল থেকে এসেছে বলে ধারনা করা হয়। একসময় উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছিল, নীলগাইয়ের প্রাকৃতিক বিস্তারের পূর্বতম সীমা। তবে প্রজাতিটির বিস্তারে প্রাকৃতিক বাধা ছিল, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী। যার ফলে তারা পূর্বদিকে খুব বেশি বিস্তার লাভ করেনি। তবুও সে সময় দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের শালবন আর নদীর পাড়ের বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমিতে, প্রচুর পরিমাণে দেখা মিলতো এদের।

IUCN Bangladesh এর প্রধান বন্যপ্রাণী তদন্তকারী সারওয়ার আলম জানান, আবাসস্থলের ক্ষতি ও অনিয়ন্ত্রিত শিকারের কারণে একটা সময় অঞ্চলগুলোতে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় নীলগাই।
সম্প্রতি তাদের পুরনো আবাসস্থলে ফিরে আসার ঘটনা, বাংলাদেশে নীলগাইদের আশ্রয় দেয়ার সুযোগকে ইঙ্গিত করে। গবেষকরা বলছেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চাইলে উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের ছোট ছোট বনভূমিতে নীলগাই ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের মতে, প্রজাতিটি যত্নে রাখা তুলনামূলক সহজ।
এ বিষয়ে গবেষকদের সঙ্গে একমত সারোয়ার আলম। তিনি বলেন, “ভারতের সীমান্তঘেঁষা উত্তর-পশ্চিম জেলাগুলোতে একটি সুরক্ষিত এলাকা গড়ে তোলা যেতে পারে। এসব জায়গায় এখনও বিশাল প্রাকৃতিক বিচরণভূমি রয়েছে। তবে এজন্য শুধু নীলগাই ফিরিয়ে আনলেই হবে না, শিকার ঠেকাতে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালাতে হবে।”
রানীশংকৈলের আব্দুর রহমান জানান, প্রতি বছরই অনেক হরিণ সীমান্ত পেরিয়ে আসে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামবাসীর বাইরে অন্যরা তা জানতে পারে না। সাধারণত মানুষ এগুলোকে ধরে ফেলে এবং এদরে মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলে।
নীলগাই হত্যার প্রবণতা কমাতে বন বিভাগের প্রাথমিক একটি কর্মসূচি রয়েছে বলে জানিয়েছেন, বন বিভাগের ঠাকুরগাঁও রেঞ্জ কর্মকর্তা তসলিমা খাতুন।
মঙ্গাবে-কে তিনি বলেন, “আমরা সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে গিয়ে মানুষকে অনুরোধ করি, ভারত থেকে আসা নীলগাই যেন হত্যা না করা হয়।”
সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক এবং IUCN Bangladesh এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা, ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, নীলগাই ফিরিয়ে আনার জন্য অবাধ বনাঞ্চল এবং বিশেষ কিছু ব্যবস্থাপনা দরকার।
তিনি বলেন, “এখানে স্বাভাবিকভাবেই নীলগাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে সেজন্য তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, আবাসস্থল রক্ষা করতে হবে, খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে।”
ব্যানার ছবি: নীলগাই এশিয়ার বৃহত্তম হরিণ প্রজাতি। ছবি: জ্যাকুব হালুনের via Wikimedia Commons (CC BY-SA 4.0).
সাইটেশন:
Hasan, S., Das, R. R., & Akash, M., (2023). Recent incursions of nilgais (Boselaphus tragocamelus) into Bangladesh, a former range country. Retrieved from https://www.researchgate.net/publication/372009482
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল – এ, ২০২৪ সালের ২০ মার্চ।