- একটি বেসরকারি সংরক্ষণবাদী প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশে এ বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অলিভ রিডলি কচ্ছপের ডিম পাওয়া গেছে।
- অলিভ রিডলির মূল আবাসস্থল, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব জেলা কক্সবাজারের বিভিন্ন দ্বীপ।
- এ সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও সমুদ্র সৈকত জুড়ে ব্যাপক সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা।
- সংরক্ষণবাদীদের দাবি, পর্যটন এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়নের বর্তমান গতি নিয়ন্ত্রণ না করা হলে, এ সাফল্য হ্রাস পেতে পারে।
চলতি বছর বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক অলিভ রিডলি কচ্ছপের ডিম পাওয়া গেছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা, পরিবেশবান্ধব নানান উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই এ সাফল্যের মূল ভিত্তি।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল, কক্সবাজার জেলার পাঁচটি কচ্ছপের হ্যাচারি—পেঁচার দ্বীপ, শিলকালী, শাহ্পরীর দ্বীপ, মাতারবুনিয়া এবং সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে মোট ১২ হাজার ৪২৫টি ডিম সংগ্রহ করেছে Nature Conservation Management (NACOM)। আগের বছর একই জায়গায় পাওয়া ডিমের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৬টি। সে হিসাবে এক বছরে ডিমের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ।
কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ২০২০–২১ সালে ডিমের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৭১৩টি। ২০২২–২৩ সালে এ সংখ্যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৬৩ তে।

সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে বাংলাদেশের জলসীমায় পাওয়া যায় পাঁচটি প্রজাতি। এগুলো হলো- অলিভ রিডলি (Lepidochelys olivacea), সবুজ কচ্ছপ (Chelonia mydas), হাকসবিল (Eretmochelys imbricata), লগারহেড (Caretta caretta) এবং লেদারব্যাক (Dermochelys imbricata)।
তবে ডিম পাড়ার জন্য নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের উপকূলে আসে মূলত তিনটি প্রজাতি—অলিভ রিডলি, সবুজ কচ্ছপ ও হাকসবিল। এর মধ্যে সবুজ কচ্ছপ ও হাকসবিল বর্তমানে বিরল হয়ে উঠেছে।
IUCN রেড লিস্টে অলিভ রিডলি কচ্ছপকে ‘বিপন্ন প্রজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রজাতিটি সাধারনত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সৈকতের বালিতে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
সাফল্যের নেপথ্যে
NACOM-এর নির্বাহী পরিচালক মনজুরুল হান্নান খান জানান, সৈকত জুড়ে ব্যাপক সংরক্ষণ কার্যক্রম এ সফলতার অন্যতম কারণ। সংরক্ষণ কার্যক্রমে বিভিন্ন সংস্থা একসঙ্গে হ্যাচারিগুলোর যত্ন নিয়েছে।
পাশাপাশি, সফলতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য নিরাপদ পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির দিকটি তুলে ধরেন তিনি।

কচ্ছপের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সবার আগে আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রজাতিটি রক্ষার উপায় খুঁজে বের করেছিলাম।”
মনজুরুল হান্নান খান বলেন, “এ সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা। আমরা স্থানীয় জনগণ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছি। আমরা তাদের বলেছি যে যদি তারা কচ্ছপ মেরে ফেলে, তাহলে তারা কম মাছ পাবে। কচ্ছপ প্রতিবেশে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এরা পানির নিচের ময়লা খেয়ে পরিষ্কার রাখার কারণে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পায়। তাই কচ্ছপ মেরে ফেললে, মাছ কম পাওয়া যাবে।”
এছাড়া স্থানীয় জনগণ ও জেলেদের মধ্যে বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন,”অনেক সময় চোরাচালানকারীরা কচ্ছপ বিক্রি করে দেয় বা স্থানীয়রা কচ্ছপ হত্যা করে। মাছ ধরার সময় জালে কচ্ছপ ধরা পড়লে সেগুলোকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে জেলেদের সতর্ক করি। তারপরও জালে আটকা পড়া কচ্ছপ ছেড়ে না দিলে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আর্থিক জরিমানাসহ প্রচলিত আইনের মুখোমুখি হতে হয় তাদের।”
অন্যদিকে, এরইমধ্যে সরকার কচ্ছপের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর একটি হলো, সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সারোয়ার আলম বলেন, “সরকার কচ্ছপের প্রজননের জন্য কক্সবাজারে পাঁচটি সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যেখানে কৃত্রিমভাবে বাচ্চা ফোটানো হয়। সৈকতের বালিতে কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দেওয়ায় মা কচ্ছপ নিরাপদে ডিম পাড়তে পারছে, ফলে প্রজননের হারও বেড়েছে।
উপকূলে উন্নয়নের অভিঘাত
২০১৫ সালের বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক পঞ্চম জাতীয় প্রতিবেদন অনুসারে, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সৈকতে কচ্ছপের বাসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, সমুদ্রে বাণিজ্যিক জালে আটকা পড়ে কচ্ছপ মারা যায়। নাহলে কচ্ছপ এবং ডিমের সংখ্যা আরও বেশি হতো।

Bangladesh Marine Life Alliance এর প্রাক্তন প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ রাসেল জানান, সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুমে, সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকতের ১০ কিলোমিটারের (৬ দশমিক ২ মাইল) মধ্যে বড় জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তবে, জেলেরা প্রায়শই এই নিয়ম অনুসরণ করেন না।
তিনি বলেন, সবুজ কচ্ছপ ও অলিভ রিডলি সমুদ্রের নিচে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা থাকতে পারে। তারপর শ্বাস নেওয়ার জন্য তাদের ওপরে উঠতে হয়। ডিম পাড়ার সময়টাতে কচ্ছপরা উপকূলের কাছাকাছি থাকে। কিন্তু মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে, দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকায় তারা মারা যায়।”
এছাড়া সংরক্ষণবাদীদের দাবি, সমুদ্র সৈকতের খুব কাছে নির্মিত হোটেল-মোটেলের আলো এবং পর্যটকদের কোলাহলের কারণে রাতে সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপের আগমন কমে গেছে। কিছু মা কচ্ছপ সমুদ্র সৈকতে এসে ডিম না রেখেই সমুদ্রে ফিরে গেছে।
এরইমধ্যে, বাংলাদেশ সরকার সামুদ্রিক পরিবেশ এবং জলজ সম্পদ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি, কনভেনশন এবং প্রোটোকল স্বাক্ষর করেছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক কচ্ছপের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রভাব ফেলছে।
সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে “Environmental Management for the Conservation of Biodiversity of Saint Martin Island” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সারোয়ার আলম বলেন, সমুদ্রসৈকত উন্নয়নের জন্য পর্যটন শিল্পের চাপ ছিল অনেক বেশি। কিছু জায়গায় এনজিও আর সরকার যৌথভাবে সংরক্ষণ প্রকল্প চালিয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট হয়নি। কারণ সরকারকে একই সঙ্গে পর্যটন আর অবকাঠামো উন্নয়নও করতে হয়েছে। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কচ্ছপের বাসা বাঁধার জায়গাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

আলম বলেন, “সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন রক্ষা করতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি ডিম পাড়ার স্থানে মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কুকুর–শিয়ালের হাত থেকে কচ্ছপকে বাঁচাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে এ বিষয়ে কাজ করছে এবং সংরক্ষণ কার্যক্রম কীভাবে আরও বাড়ানো যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে টেকনাফ সৈকতে অলিভ রিডলি কচ্ছপ আসছে, তাই ওই এলাকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ব্যানার ছবি: সামুদ্রিক কচ্ছপের বাচ্চা। ছবি: রেইট বাটলার
সাইটেশন:
Hossain, M. A., Mahfuj. M. S. C., Rashid, S. M. A., Miah, M. I. & Ahsan, M. N. (2013). Present status of conservation and management of sea turtle in Cox’s Bazar district, Bangladesh. Mesopotamian Journal of Marine Sciences. Retrieved from https://www.researchgate.net/publication/323257565_Present_status_of_conservation_and_management_of_sea_turtle_in_Cox’s_Bazar_district_Bangladesh
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল।