- কয়েক দশক ধরে রাসেল ভাইপারকে প্রায় বিলুপ্ত প্রাণী হিসেবে মনে করা হতো বাংলাদেশে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত জানতেই পারেননি, সাপটি দেশের কোন কোন এলাকায় সম্ভাব্য কত সংখ্যক ছড়িয়ে রয়েছে।
- সংখ্যায় বাড়তে থাকায়, মানুষের জন্য হুমকি তৈরি করছে সাপটি। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, রাসেল ভাইপারের কামড়ে ।
- সম্প্রতি দেশটিতে সাপের কামড়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায়, হঠাৎ করেই নির্বিচারে সব ধরনের সাপ মারার প্রবণতা বেড়ে গেছে মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে মে থেকে জুন মাসে বোরো ধান কাটার মৌসুমে, এই প্রবণতা বেশি।
- সংকট মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অকারণে সাপকে না মারা ও সাপের কামড় সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তুলতেই, এই ব্যবস্থা। এ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইল অ্যাপে শিক্ষামূলক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
রাসেল ভাইপার, বাংলাদেশে যা চন্দ্রবোড়া হিসেবেও পরিচিত। এক দশক আগেও প্রায় বিলুপ্ত বলে মনে করা হতো এটিকে। যদিও শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বিভিন্ন নথিপত্রে সাপটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তবুও ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত রাসেল ভাইপার (Daboia Russelii) সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই ছিলোনা বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের কাছে। তবে সম্প্রতি এ সাপের ঘন ঘন দেখা মেলা, স্থানীয় মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশে এই সাপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ধান কাটার মৌসুমে। এ বছর বোরো ধান কাটার মৌসুম- মে ও জুন মাসে সাপের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এবং কামড়ের ঘটনায় আতংকিত সাধারণ মানুষ।
বিষধর রাসেল ভাইপারের কামড়ে কতজনের মৃত্যু হয়েছে দেশটিতে, তার নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও সাপটিকে ঘিরে দেশজুড়েই তৈরি হয়েছে ভয়ের পরিবেশ। বিশেষ করে কৃষিজমিতে কাজ করেন, এমন মানুষের মধ্যে এই ভয় বেশি। তাই কোথাও সাপ দেখা গেলে, সেটি বিষধর কি না, তা বুঝে দেখার চেষ্টা না করেই প্রায়ই স্থানীয়রা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে এদের।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘন ঘন ফসল চাষের কারণে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা বাড়ে। আর ইঁদুর রাসেল ভাইপারের প্রধান খাদ্য। খাবারসহ অনুকূল পরিবেশ সাপটির বংশবিস্তারের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এখনো বাংলাদেশে সাপটির এমন হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার সঠিক কারণ নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।
গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, সম্প্রতি দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা ও পটুয়াখালীতে রাসেল ভাইপার দেখা গেছে।
গবেষণাটি আরো বলছে, এর আগে এই সাপ ১১টি জেলায় দেখা যেতো। জেলাগুলো হলো—নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলার মধ্যে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত বিশ জন প্রাণ হারিয়েছেন এই সাপের কামড়ে।

নব্বইয়ের দশকের আগে, চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাবে কৃষকরা সাধারণত বছরে এক দুইবারই ধান চাষ করতেন এবং বাকি সময় খালি পড়ে থাকতো জমি। এরপর সেচ ব্যবস্থার প্রচলন এবং মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায়, কৃষকরা একই জমিতে বছরে দুই এর অধিক ফসল চাষ করতে শুরু করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরিদ আহসান, রাসেল ভাইপার নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, বছরের অনেকটা সময় কৃষি জমিতে ফসল থাকায়, ইঁদুরও ওই পুরোটা সময় জুড়ে মাঠে থাকে। ইঁদুর এই সাপের প্রধান খাবার হওয়ায় প্রজনন সক্ষমতাও বাড়তে থাকে সাপটির।
বাংলাদেশে সাপ, সাপের কামড় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ম্যানেজমেন্ট অব স্নেকবাইট অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি সামুদ্রিক সাপ। আর বিষধর সাপের মধ্যে কিং কোবরাসহ তিন ধরনের গোখরা, পাঁচ ধরনের কেউটে, দুই প্রজাতির কোরাল, ছয় প্রজাতির সবুজ পিট ভাইপার এবং এক প্রজাতির রাসেল ভাইপার রয়েছে। বাকিগুলো ক্ষতিকর নয়।
২০২৩ সালে করা এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭৫১০ জন মানু সাপের কামড়ে মারা যায়। বর্ষার সময় সাপের কামড়ে যাদের মৃত্যু ঘটে, তাদের অধিকাংশের জীবিকাই কৃষিকাজ।
এই সংকট মাথায় রেখে, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে একটি সাপের বিষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Venom Research Institute) চালু করে। বিশেষ কিছু সাপের বিষের প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এটির প্রধান গবেষক অনিরুদ্ধ ঘোষ মঙ্গাবে-কে জানান, “অ্যান্টি-ভেনম বা প্রতিষেধক তৈরি করা সময়ের কাজ। আমরা এখনও বিভিন্ন বিষধর সাপের প্রতিষেধক তৈরির গবেষণার প্রাথমিক ধাপে আছি।”
অনিরুদ্ধ ঘোষ আরো বলেন, সাপের কামড় শনাক্ত করতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মানুষের অজ্ঞতা এবং সাপ চিহ্নিত করতে না পারা। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনায় বিষ আছে কি না, তা জানার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশে।
”ফলে, আমাদের চিকিৎসা নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ওপর, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়,” বলেন ঘোষ, যিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করছেন।
“কোন সাপ কামড়েছে যখন তা নিশ্চিত হই, তখন সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী ভারত থেকে আমদানি করা প্রতিষেধক আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর প্রযোগ করি, যা কিছুটা কাজ করে,” যোগ করেন ঘোষ।

অকাতরে সাপ মেরে ফেলার ভয়াবহ প্রবণতা থেকে রক্ষা পেতে, বাংলাদেশ সরকার সচেতনমূলক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সাপ কেনো মারা উচিৎ নয়, সে সম্পর্কে তথ্য প্রচার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইল ফোন অ্যাপে।
বাংলাদেশ বন বিভাগের, শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টারের হারপেটোলজিস্ট বা সাপ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সোহেল রানা মঙ্গাবে-কে জানান, “এই বছর ফেসবুকে কয়েকটি সচেতনতামূলক পোস্ট দিয়েছে বন বিভাগ। এতে রাসেল ভাইপারসহ বিষধর ও অ-বিষধর সাপ এবং সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া হয়। সাপ হত্যা না করার অনুরোধও করা হয়েছে পোস্টগুলোতে ।”
এর বাইরে সাধারণ মানুষদের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে এবং সচেতনতা বাড়াতে সরকার একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে, যার নাম Awareness in Snakebites । অ্যাপ স্টোর থেকে এন্ড্রয়েড ও অ্যাপল উভয় ফোনে সহজেই ডাউনলোড হয় এটি।
ব্যানার ছবি: কৃষকদের জন্য রাসেল ভাইপারকে গুরুতর হুমকি হিসেবে ধরা হয়। ছবি: Rama Narayanan via Wikimedia Commons (CC BY 4.0).
সাইটেশন:
Ahsan, M. F., and Saeed, M. A. (2018). Russell’s Viper (Daboia russelii) in Bangladesh: Its Boom and Threat to Human Life. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh Science. 44(1):15-22 doi:10.3329/jasbs.v44i1.46542
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট।