- বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০০টিরও কম চশমাপরা হনুমান এবং ৬০০টির মত মুখপোড়া হনুমান রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনগুলোতে এদের দেখতে পাওয়া যায়।
- আইইউসিএন চশমাপরা হনুমান ও মুখপোড়া হনুমানকে যথাক্রমে অতি-বিপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। সাম্পরতিক এক গবেষণায়, বাংলাদেশে এই দুই প্রজাতির মধ্যে সংকরায়নের প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে।
- সংকরায়ন পরিবেশগত পরিবর্তন বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই দুই প্রজাতির হনুমানের জিনগত স্বাস্থ্য এবং বন্য পরিবেশে তাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে গবেষকরা গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
- গবেষণায় দেখা গেছে— সংকরায়নের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্যে দায়ী নির্বিচারে বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং শিকার।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনগুলোতে হনুমানদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংকরায়নের এক উদ্বেগজনক প্রবণতা উঠে এসেছে। জার্মানির প্রাইমেট সেন্টার পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, চশমাপড়া হনুমান (Trachypithecus phayrei) এবং মুখপোড়া হনুমান (Trachypithecus pileatus) এর মধ্যে সংকরায়ন হচ্ছে, যেটা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের এই দুটি প্রজাতি যথাক্রমে অতি-বিপন্ন এবং বিপন্ন হিসেব আইইউসিএন-এর তালিকাভুক্ত।
গবেষকদের মতে বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট কারণে বিপন্ন এই প্রাণীগুলোর মধ্যে সংকরায়ন ঘটছে, যা কয়েক প্রজন্মের মধ্যে তাদেরকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
গবেষণাটির প্রধান গবেষক তানভীর আহমেদ মঙ্গাবে-কে জানান, “বাংলাদেশের হনুমানের প্রজাতিগুলো সংখ্যায় কম এবং বিচ্ছিন্ন, যার কারণে তাদের মধ্যে জিনের আদান-প্রদান সীমিত। এই সীমিত জনসংখ্যার মধ্যে সংকরায়ন তাদের বিলুপ্তির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, আমাদের আইন কেবল মূল প্রজাতির হনুমান রক্ষায় যত্নশীল। সংকর প্রজাতিগুলো তাতে অরক্ষিতই থেকে যায়। যদি সংকর প্রজাতিগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে, তাহলে বনের প্রতিবেশে তাদের ভূমিকা নিয়ে আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।”
তানভীরের সঙ্গে একমত পোষণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ. খান জানান, আন্তঃপ্রজননের ফলে জন্ম নেওয়া হনুমানগুলো সাধারণত বেশি দিন বাঁচে না।
তিনি বলেন, “সংকর হনুমানরা সাধারণত প্রজননক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না। ফলে হনুমানের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।”
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব প্রাইমাটোলজি-তে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যবেক্ষণে থাকা ৯৮টি হনুমানের দলের মধ্যে ৮টি দলে চশমাপরা ও মুখপোড়া উভয় প্রজাতির হনুমান ছিলো।
তানভীর জানান, “আমরা ল্যাবে প্রজাতির জিনগত নমুনা বিশ্লেষণ করে সংকরায়ণের একটি ঘটনা নিশ্চিত করেছি। এই হনুমানটির মা ছিল এক মুখপোড়া হনুমান এবং বাবা ছিল এক চশমাপরা হনুমান। সংকর আরেকটি নারী হনুমানের মধ্যে মাতৃত্বের লক্ষণ দেখা গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে অন্তত নারী সংকর হনুমানগুলো বাচ্চা জন্ম দিতে সক্ষম।”
তিনি আরও বলেন, “একটি স্বতন্ত্র প্রজাতির জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়ে যখন তাদের সংকর নারী হনুমানেরা প্রজননে সক্শম হয়। প্রজননক্ষম সংকর নারী হনুমান দুই প্রজাতিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসার হুমকি সৃষ্টি করে, কারণ তাদের সন্তানদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগুলো মিশতে শুরু করে।”
গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘চশমাপরা’ কালো হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমান — যাদের মাথার ওপর কালো চুলের ঝাঁক রয়েছে, সংকরায়নের কারণে তারা আদিম স্বতন্ত্র চেহারা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে রয়েছে।
গবেষকরা প্রায় পাঁচ বছর ধরে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি বনে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো—লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, রাজকান্দি সংরক্ষিত বন, পাথারিয়া হিল সংরক্ষিত বন এবং আতোরা হিল সংরক্ষিত বন।
এই গবেষণায় ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল এবং ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯২ দিনের মাঠ জরিপ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মিশ্র প্রজাতির দলগুলোকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য স্থানীয় তিনজন প্রশিক্ষিত বন পরিদর্শককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সংকরায়ন কেন উদ্বেগের কারণ?
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাইমেটদের মধ্যে সংকরায়ন তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও, এটি বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া, উদ্ভুত পরিস্থিতির মূল নিয়ামক। মানুষের নানান কার্যক্রম জীববৈচিত্র্যের জন্য কতটা মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে, এটি তার একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশে সংকরায়ন এবং এ থেকে উদ্ভূত সংকট ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় বিশেষ মনযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবী।
গবেষণায় বলা হয়েছে—সংকরায়ন হলো প্রতিবেশগত পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই পরিবর্তন প্রজাতির জিনগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির বার্তা দেয়। এই গবেষণাকে যুগান্তকারী হিসেবে উল্লেখ করেন তানভীর। গবেষণাটি বাংলাদেশে এই দুই প্রজাতির হনুমানদের মধ্যে সংকরায়ন এবং তাদের সমগ্র বিচরণভূমিতে সংকরায়নের ব্যাপ্তি নিয়ে করা প্রথম প্রতিবেদন।
সংকর প্রাণী প্রজননক্ষম হলে মূল প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির দিকে যেতে পারে। এই গবেষণার একজন গবেষক সাবিত হাসান বলেন, “এছাড়াও, প্রজাতিদের মধ্যে মিশ্রণের ফলে আগে বিচ্ছিন্ন থাকা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান রোগ অন্যান্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা বন্যপ্রাণী এবং মানুষ উভয়ের জন্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। কারণ এই প্রাণীগুলো প্রায়শই অবৈধ কেনাবেচার শিকার হয়।”
গবেষণায় সংকরায়নের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ যেমন—বন উজাড়, আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং প্রাইমেট বর্গের প্রাণীদের শিকার ও ফাঁদে ফেলাকে দায়ী করা হয়।
তানভীর বলেন, “প্রজননক্ষম সংকরের উপস্থিতি বিশেষভাবে আশঙ্কাজনক, কারণ এই দুটি বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জিন প্রবাহ ভবিষ্যতে তাদের জিনগত স্বরূপ স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করতে পারে।”


বাংলাদেশের প্রাইমেট বর্গ
বাংলাদেশে যে ১২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া যায়, এদের মধ্যে দশটি হলো প্রাইমেট বর্গভুক্ত। সংকরায়ন গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫০০টিরও কম চশমাপরা হনুমান এবং ৬০০টির মত মুখপোড়া হনুমান রয়েছে।
চশমাপড়া হনুমানের পিঠের লোম বাদামি থেকে ধূসর-বাদামি, পেট ও মুখের লোম সাদা এবং চোখের চারপাশে সাদা বলয় থাকার কারণে এদেরকে ‘চশমা পরা’ বলে মনে হয়। এদের মুখ ও হাত-পা কালো এবং মাথার লম্বা চুলগুলো পেছনের দিকে থাকে। এছাড়া এদের লেজ শরীরের চেয়ে লম্বা এবং এর ডগায় গাঢ় রঙের চুলের একটি গুচ্ছ রয়েছে।
মুখপোড়া হনুমান, এর মাথায় থাকা মুকুট সদৃশ লম্বা খাড়া চুলের জন্য পরিচিত। এদের মুখ কালো, উপরের লোম ধূসর থেকে কালচে-ধূসর এবং নিচের লোম বাদামি-হলুদ বা কমলা রঙের। এদের লেজের শেষ অর্ধেকটা কালচে রঙের হয়।
গবেষণায় বলা হয়, সরকারের উচিত আবাসস্থল সংরক্ষণে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং বিচ্ছিন্ন প্রাইমেট জনসংখ্যার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য করিডোর তৈরি করা। এটি হনুমানের প্রাকৃতিক বিচরণে সহায়তা করবে।
তানভীর বলেন, “যদি আমরা এখন পদক্ষেপ না নেই, তাহলে আমরা কেবল এই দুই প্রজাতির হনুমান নয়; বরং বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বো।”

ব্যানার চিত্র: সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মুখপোড়া হনুমান মায়ের সাথে একটি সংকর শিশু হনুমান। ছবি: হরিশ দেববর্মা।
সাইটেশন:
Ahmed, T., Hasan, S., Nath, S., Biswas, S. … Roos, C. (2024). Mixed-Species Groups and Genetically Confirmed Hybridization Between Sympatric Phayre’s Langur (Trachypithecus phayrei) and Capped Langur (T. pileatus) in Northeast Bangladesh. International Journal of Primatology. doi:10.1007/s10764-024-00459-x
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবর।