- সম্প্রতি বাংলাদেশ বন বিভাগ অপরাধ দমনের কৌশল হিসেবে আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে ছিল।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী বিষয়ক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এখনও স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভরশীল। মূলত টেলি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা রাখে স্বেচ্ছাসেবীরা।
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী অপরাধ ও মৃত্যু মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের সীমিত সম্পদকে আরও কার্যকর করবে।
সম্প্রতি সংরক্ষণ কার্যক্রম কৌশলে পর্যবেক্ষক ড্রোন যুক্ত করেছে, বাংলাদেশ বন বিভাগ। ড্রোনের মাধ্যমে আকাশ থেকে বন্যপ্রাণী শিকারের জায়গা পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে এ প্রযুক্তিকে একটি কৌশল বা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে তারা।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট (ডব্লিউসিসিইউ)-এ পাখি শিকারিদের ধরার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন, আবদুল্লাহ আস সাদেক। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি গোপালগঞ্জের একটি পাখি অভয়ারণ্যে ড্রোন পরিচালনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ড্রোন ক্যামেরা চালানোর চর্চা করেন।
একদিন বিকেলে, তিনি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় একটি বিলের উপর দিয়ে ড্রোনটি ওড়াচ্ছিলেন। সে সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি বিশাল বিলের ওপর অনেকগুলো পাখির ফাঁদ দেখতে পান তিনি। বিলটি ছিল অগভীর ও অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায়।
তিনি দেখেন, বিলের বিভিন্ন অংশে পাখির জন্য ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। সেগুলো পাতলা নাইলনের সুতোর ফাঁস দিয়ে তৈরি। সাথে সৌরশক্তিচালিত লাউডস্পিকারে কৃত্রিম পাখির ডাক বাজানো হচ্ছে। পাখির কৃত্রিম ডাক শুনে, আকাশে ওড়া পরিযায়ী পাখিরা জলাশয়ে নেমে আসছে। মূলত পরিযায়ী পাখিদের ফাঁদে ফেলতেই এই ব্যবস্থা। পাখিরা যখন নাইলনের সূতোয় তৈরি ফাঁদের কাছে আসে তখন তাদের ঘাড়গুলো ফাঁসে আটকে যায়। আবদুল্লাহ আস সাদেক ড্রোনের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি দেখতে পান।
সেই দিনের কথা মনে করে সাদেক মঙ্গাবে-কে বলেন, জলাশয়ের তলদেশ অসম ছিল। সেখানে একমাত্র দেশী ছোট নৌকাই যেতে পারে। বিশাল বিলটি টহল দিতে অন্তত এক দিন সময় লাগে। কিন্তু ড্রোন দিয়ে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে ফাঁদগুলো খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে।
অভিযানের মাধ্যমে অবৈধ পাখির ফাঁদ জব্দ করা হয়। এ সময় উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি পাখি। জেলে পাঠানো হয় দুইজন শিকারীকে।

সম্প্রতি, বন্যপ্রাণী শিকার এবং পাচার মোকাবিলায় জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর থেকে এক সেট সরঞ্জাম পেয়েছে ডব্লিউসিসিইউ । ড্রোন ছাড়াও সরঞ্জামগুলোর মধ্যে ছিল ওয়্যারলেস ওয়াকি-টকি সেট, জিপিএস ট্র্যাকার, উচ্চ রেজোলিউশন ডিএসএলআর ক্যামেরা, জিপিএস-সক্ষম অ্যাকশন ক্যামেরা, প্রাণীদের জন্য আইডি মাইক্রোচিপ ইমপ্লান্ট, আইডি চিপ রিডার, বোরস্কোপ ক্যামেরা, নাইট-ভিশন বাইনোকুলার, ফরেনসিক এবং ট্রানকুইলাইজিং সরঞ্জাম।
বাংলাদেশের আশেপাশের দেশগুলো এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। ২০১২ সালে নেপাল চালকবিহীন আকাশযান, ক্যামেরাসহ রিমোট কন্ট্রোল ড্রোন ও জিপিএসের ব্যবহার শুরু করে। পরের বছর ভারতেও একই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু
নভেম্বর মাসে, শেরপুর জেলার মধুটিলা ইকো পার্কে বন বিভাগ একটি মৃত হাতি খুঁজে পায়। স্থানীয়দের ধারণা, হাতিটি খাবারের সন্ধানে পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রামে ঢুকে পরে। এরপর হাতিটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়।
ফেব্রুয়ারিতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা পঞ্চগড় জেলার নাগর নদীতে একটি মৃত চিতাবাঘ খুঁজে পান। স্থানীয়রা জানান, দল বিচ্ছিন্ন চিতাবাঘটি একটি মৃত গরু খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যায়। একজন কৃষক ওই গরুটিকে বিষ দিয়েছিলেন। সেই কৃষক ভেবেছিলেন, গরুটিকে শিয়াল আক্রমণ করেছে বা কামড়েছে। শিয়াল কামড়ানোর ফলে গরুর জলাতঙ্ক অথবা আক্রমণাত্বক হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই ঐ কৃষক গরুটিকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন। সেই বিষ মেশানো গরুর মৃতদেহ খেয়ে চিতাবাঘটি মারা যায়।
বন্যপ্রাণী পরিদর্শকরা মনে করেন, তাদের কাছে আগে থেকে আধুনিক প্রযুক্তি থাকলে তারা এ দুটো চিতাবাঘ ও গরুর মৃত্যু ঠেকাতে পারত।
এ বিষয়ে সাদেক বলেন, ড্রোন থাকলে তারা পথভ্রষ্ট প্রাণীদের ওপর নজর রেখে তাদের উদ্ধার করতে পারতেন।

প্রযুক্তি: বন্যপ্রাণী রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার
চোরাগোপ্তা শিকার বন্ধে ড্রোন, অ্যাকোস্টিক ফাঁদ, স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্তকরণ, রেডিও কলার এবং ক্যামেরা ফাঁদের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ দেশ ।
এছাড়াও স্পেশাল মনিটরিং অ্যান্ড রিপোর্টিং টুল (SMART) এবং হোস্টাইল অ্যাক্টিভিটি ওয়াচ কার্নেল (HAWK) এর মতো এআই-ভিত্তিক সরঞ্জাম প্রায়ই ব্যবহৃত হয় দেশগুলোতে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ ও আইনজীবীদের মতে, বন্যপ্রাণীর গতিবিধি অনুসরণ ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও অপরাধের তথ্য, অপরাধমূলক কার্যকলাপ বিশ্লেষণ এবং টহল অঞ্চলগুলোতেও প্রযুক্তি অপরিহার্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আইন ও তদন্ত বিশেষজ্ঞ জেনিফার নল বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্তের স্বার্থে কর্মকর্তাদের চোখে দেখা ও কানে শোনার ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তার মতে কর্মকর্তারা নাইট ভিশন, স্কোপ এবং শ্রবণযন্ত্রের মত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে দূরবর্তী এলাকা ও অন্ধকারে ভালোভাবে দেখতে ও সূক্ষাতিসূক্ষ শব্দ আরও ভালোভাবে শুনতে পারবেন তারা।
২০২৪ সালের মে মাসে, জেনিফার নল বাংলাদেশী বন্যপ্রাণী পরিদর্শকদেরকে একটি প্রশিক্ষণ দেন। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনের কৌশল শেখাতে এই প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। প্রশিক্ষণে শেখানো হয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে টহল দেয়া, তদন্ত করা, সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করা এবং অপরাধীকে আটক করা যায়।
তিনি বলেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যপ্রাণী রক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। সেসব তথ্য দিয়ে চোরাশিকারের হটস্পট চিহ্নিত করা, টহলদারি পরিচালনা করা ও চোরাশিকারিদের স্থান পরিবর্তনের ধরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়। জেনিফার নল বলেন, এভাবে পাচারের মাধ্যমগুলো খুঁজে বের করে বন্যপ্রাণী অপরাধ সনাক্ত এবং তদন্ত করা সম্ভব।
কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, বিশ্বের অনেক দেশে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাজার অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সে সময় সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে কমে যায় আইন প্রয়োগের হার। ফলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনকারী দলগুলোর কাজের চাপ বেড়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে, অনুপ্রবেশকারী ও চোরাশিকারিদের ধরতে ক্যামেরা ফাঁদ ও নির্ধারিত সীমানার মধ্যে অনুপ্রবেশকারীকে সনাক্তকরণ পদ্ধতির (পেরিমিটার ইনট্র্রুশন ডিটেকশন সিস্টেম) মতো প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে চোরাশিকারিদের মোকাবিলা করা সম্ভব। একটি নীতিমালা বা নীতি-সারসংক্ষেপেও (policy brief) এ বিষয়ে বলা রয়েছে।


বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বর্তমান অবস্থা
২০১২ সালে ডব্লিউসিসিইউ প্রতিষ্ঠার পর থেকে, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীরা প্রায় ৩৫ হাজার পাখি, ১০ হাজারেরও বেশি সরীসৃপ এবং প্রায় ১৩ হাজার স্তন্যপায়ী প্রাণী উদ্ধার করেছেন। এছাড়াও বন্যপ্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ জব্দ করা হয়েছে, প্রায় ১৪ হাজার ৫০০টি।
এই সময়ের মধ্যে, ডব্লিউসিসিইউ ২৬ হাজারেরও বেশি অপরাধ সনাক্ত করেছে। এছাড়াও বন্যপ্রাণী শিকার এবং পাচারের অভিযোগে ২১৯ জন অপরাধীকে আটক করেন তারা।
এই অপরাধগুলোর বেশিরভাগ সনাক্ত করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় সংরক্ষণ গোষ্ঠী ও আইন প্রয়োগকারী গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে।
সাদেক বলেন, ডব্লিউসিসিইউ প্রায় ১৫০টি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দলের সাথে যুক্ত। এই দলগুলোর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবকরা ডব্লিউসিসিইউ-কে ফোন কল এবং ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দেন।
স্বেচ্ছাসেবকরা কাউকে শিকার বা পাচার করতে দেখলে অথবা কোনও বন্য প্রাণীকে বিপদে পড়তে দেখলে ডব্লিউসিসিইউ-কে জানান। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ফোনে যোগাযোগ তরে তারা।
ডব্লিউসিসিইউ-এর পরিচালক সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, তাদের কর্মী সংখ্যা কম। তাদের এ সীমাবদ্ধতাকে কিছুটা সহজ করে দেয় টেলিযোগাযোগ। তবে বন বিভাগের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের হটস্পটগুলোতে দ্রুত পৌঁছাতে পর্যাপ্ত যানবাহনেরও অভাব রয়েছে তাদের।
পাটোয়ারী বলেন, একজন সাধারণ মানুষও স্মার্টফোন ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিপদগ্রস্থ বন্য প্রাণীর ছবি, ভৌগলিক অবস্থান, অপরাধী ও অপরাধমূলক কার্যকলাপের তথ্য দিয়ে তারা প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে সহায়তা করে থাকে।
২০২০ সাল থেকে, জাতীয় জরুরি পরিষেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন কলের মধ্যে ডব্লিউসিসিইউ-কে যুক্ত করা হয়েছে। ইউনিটটির চারটি হটলাইনও রয়েছে।
এছাড়া বন্যপ্রাণী অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে, বেশ কিছু ইউটিউবার এবং ভিডিও প্রোমোটার বন্যপ্রাণী পরিদর্শকদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন।
এছাড়াও ডব্লিউসিসিইউ সম্প্রতি আইটু সফটওয়্যার -এর ব্যবহার শুরু করেছে। সফটওয়্যারটি অর্থপূর্ণ ইনফোগ্রাফিক্স তৈরি করতে পারে এবং যোগাযোগের জন্য ভালো। এই সফটওয়ারে বন্যপ্রাণী অপরাধ, অপরাধের ধরণ, অপরাধী গোষ্ঠী, তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং হটস্পট সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
তদন্ত পরিচালনার সময়, এসব তথ্য হাতে থাকলে শিকারীকে ধরা এবং তাকে বিচারের আওতায় আনা সহজ হয় বলে মনে করেন জেনিফার নল। তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে তথ্য ও প্রযুক্তি মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করতে পারে।
ব্যানার ছবি: বাংলাদেশে একটি কাঠ শালিক। ছবি: তারেক উদ্দিন আহমেদ, via Fickr (CC BY 2.0)।
Citation:
Glasson, A. (2022). The role of technology in combating wildlife crime. ENACT 27. Retrieved from: https://www.academia.edu/81674182/The_role_of_technology_in_combating_wildlife_crime
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল এ, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর।