- রাজধানীতে সম্প্রতি চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে মিঠা পানির কচ্ছপের একটি বড় চালান জব্দ করেছে, বাংলাদেশ বন বিভাগ ।
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মিঠা পানির কচ্ছপের ভোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। এই ভোক্তাদের একটি বড় অংশ পূর্ব এশিয়া থেকে আসা বিদেশী নাগরিক। তারা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।
- সংরক্ষণবিদরা বলছেন, এখনই এই অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ না করলে বাংলাদেশ থেকে একাধিক প্রজাতির কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী পরিদর্শকরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকায় একটি আন্তঃনগর বাস আটক করেন। এরপর লাগেজ কম্পার্টমেন্ট থেকে জীবন্ত কচ্ছপে ভরা দুটি বাক্স উদ্ধার করেন তারা।
চালানটি দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়ার শেরপুর উপজেলার উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল বলে জানায় বাস কর্তৃপক্ষ। গন্তব্য থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার (১৬৮ মাইল) দূরে কুমিল্লা হাইওয়ে (এন১১৪) থেকে এগুলো তোলা হয়। বাস চালক সিদ্দিকুল ইসলাম জানান, এই রুট দিয়ে প্রতিদিন একই রকম চালান পরিবহণ করা হয়।
এই অভিযানের সূত্র ধরে, ৩০ ডিসেম্বর বন্যপ্রাণী পরিদর্শকরা কুমিল্লার পার্শ্ববর্তী জেলা চাঁদপুরের একটি কাঁচাবাজারে, কচ্ছপ সংরক্ষণের একটি অস্থায়ী গুদাম খুঁজে পান। সেখানে তারা ১,৩০০টি জীবন্ত মিঠা পানির কচ্ছপ জব্দ করেন। কচ্ছপগুলোর মোট ওজন ২৮০ কেজি (৬১৭ পাউন্ড)। এ সময় গুদামে তিন প্রজাতির কচ্ছপ খুঁজে পায় বনবিভাগ। প্রজাতিগুলো হলো ইন্ডিয়ান রুফড টার্টল (pangshura tecta), ইন্ডিয়ান আইড টার্টল (Morenia petersi) এবং ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাপশেল টার্টল (Lissemys punctata)। তিনটিই বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা)আইন,২০১২ অনুযায়ি সংরক্ষিত প্রজাতি।
এর আগে বন বিভাগ ১০ ডিসেম্বরে, চাঁদপুরে আরেকটি অস্থায়ী গুদামে অভিযান চালিয়ে এই তিন প্রজাতিরই ৮০০ কেজি (১৭৬৪ পাউন্ড) কচ্ছপ জব্দ করে।
এসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের (ডব্লিউসিসিইউ) পরিচালক সানাউল্লাহ পাটোয়ারী। তিনি মঙ্গাবে-কে বলেন, মাত্র ২০ দিনের মধ্যে এই বিপুল সংখ্যক কচ্ছপ জব্দ করা হয়েছে। যা দেশে অবৈধ কচ্ছপ ব্যবসা বা চোরাচালানের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক প্রসারের ইঙ্গিত দেয়।
১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে কচ্ছপ ব্যবসা নিষিদ্ধ। তারপরও মিঠা পানির কচ্ছপ শিকার এবং পাচার অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবৈধ পাচার এবং সীমিত পরিসরে স্থানীয় ব্যবহার এর অন্যতম কারণ।
সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পে অনেক বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন। তাদের জন্যই হয়ত কচ্ছপের মাংসের চাহিদা বাড়ছে।


কচ্ছপের বাজারে নতুন ক্রেতা
মিঠা পানির প্রাণীদের জন্য বাংলাদেশ এক বৈচিত্র্যময় আবাসস্থল। কারণ দেশটি শত শত নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানে রয়েছে ঝর্ণা, খাল, মোহনা, বিল, পুকুর এবং অগনিত জলাশয়।
গবেষণা বলছে, পেশাদার শিকারীরা জলাশয় ও কচ্ছপের বিভিন্ন আবাসস্থল থেকে এগুলো ধরে আনেন। এরপর সেগুলো অস্থায়ী গুদামে সংরক্ষণ করেন। পরে কচ্ছপগুলোকে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় পাঠানো হয়।
বন্যপ্রাণী পরিদর্শকরা জানান, পেশাদার শিকারীদের যোগাযোগ রয়েছে একদল চোরাকারবারী। তারা বছরের পর বছর ধরে পাঁকাল বা কুঁইচা মাছ (Synbranchidae) চাষের আড়ালে কচ্ছপের অবৈধ ব্যবসা করে আসছেন।
বাংলাদেশের কিছু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের খাদ্যতালিকায় রয়েছে কচ্ছপের মাংস। এছাড়াও, ঢাকায় কিছু অভিজাত এলাকায় বিদেশীরা কচ্ছপের মাংস কেনেন।
২০১৩ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশে জীবন্ত কচ্ছপ সরবরাহের মূল গন্তব্যগুলো হলো- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর।
গত ২৮ ডিসেম্বর চোরাকারবারীরা কচ্ছপগুলোকে ঢাকা দিয়ে বগুড়ার শেরপুরে নিয়ে যাচ্ছিল। উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুরের মত জেলাগুলোর সাথে সড়কপথে যোগাযোগের জন্য শেরপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। এখানে চীনা সংস্থাগুলো রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে নিযুক্ত রয়েছেন।
এছাড়াও শেরপুরের নিকটবর্তী পাবনা জেলায় দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কর্মরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাশিয়ান কর্মী রয়েছেন।
ডব্লিউসিসিইউ-এর বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, “দেশের উত্তর এবং অন্যান্য অঞ্চলে বিদেশীদের উপস্থিতি দেখে আমাদের সন্দেহ হয় যে কচ্ছপের মাংসের বাজার প্রসারিত হয়েছে। আমাদের কাছে প্রাথমিক প্রমাণ আছে যে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে জীবন্ত কচ্ছপ এবং কচ্ছপের খোলস ভারতে পাচার করা হচ্ছে।”

বিলুপ্তির পথে মিঠা পানির কচ্ছপ
২০১৩ সালের গবেষণাটিতে বলা হয়, মিঠা পানির যে কচ্ছপগুলো প্রায়শই বেচাকেনা হয় সেগুলো আইইউসিএন-এর রেড লিস্টে সংকটাপন্ন হিসেবে উল্লিখিত। নির্দিষ্ট এই প্রজাতিগুলো পুরো বিশ্বেই হুমকির মুখে রয়েছে। এই বিপন্ন প্রজাতিগুলো হলো গাঙ্গেয় সফটশেল টার্টল (Nilssonia gangeticus), স্পটেড পন্ড টার্টল (Geoclemys hamiltonii), ইন্ডিয়ান আইড টার্টল (Morenia petersi), ইন্ডিয়ান রুফড টার্টল (Pangshura tecta) এবং সফটশেল পিকক টার্টল (Aspideretes hurum)।
১৯৯০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মিঠা পানির কিছু কচ্ছপ নিয়মিতভাবে বিক্রি হয়। যার মধ্যে রয়েছে ন্যারো হেডেড সফটশেল টার্টল (Chitra indica), নর্দান রিভার টেরাপিন (Batagur baska), সিলেট রুফটেড টার্টল (Pangshura sylhetensis) এবং ব্রাহমিনি রিভার টার্টল (Hardella thurjii)।
আইইউসিএন-এর ২০১৫ সালে করা রেড লিস্টে চারটি প্রজাতিকেই অতি বিপন্ন বা বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
২০১৫ সালে রেড লিস্টে থাকা দেশের ৩০ প্রজাতির কচ্ছপের ওপর পর্যালোচনা করা হয়। যার মধ্যে ২২ প্রজাতিকে বিপন্ন এবং চারটিকে প্রায় হুমকির সম্মুখীন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে যত কচ্ছপ আছে সেগুলোও আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং শিকার বেড়ে যাওয়ার কারণে হুমকির মুখে পড়তে পারে। অধ্যাপক শফিক হায়দার ২০১৫ সালের রেড লিস্ট বা লাল তালিকার কারিগরি পর্যালোচক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
বাংলাদেশের মিঠা পানির কচ্ছপ মূলত জলজ প্রাণী। তারা কেবলমাত্র ডিম পাড়ার জন্যই তীরে আসে। বেশিরভাগই সর্বভুক বা মাংসাশী। তবে কিছু স্ক্যাভেঞ্জার অর্থাৎ যারা ময়লা খায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এমন ধরণের কচ্ছপও রয়েছে।
অধ্যাপক শফিক হায়দার বলেন, ২০১৫ সালে করা বাংলাদেশের লাল তালিকায় ইন্ডিয়ান রুফড টার্টল এবং স্পটেড ফ্ল্যাপশেল টার্টলকে সর্বনিম্ন উদ্বেগ বা লিস্ট কনসার্ন-এর তালিকায় ফেলা হয়েছে। তবে লাগামহীন চোরাচালান শীঘ্রই এই দুই প্রজাতিকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে পরবর্তী লাল তালিকার পর্যালোচনা শুরু হওয়ার কথা। সেই সময়ে, বাংলাদেশের রেড লিস্টে না থাকা বাকি প্রজাতির সকল কচ্ছপকে বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন তিনি।
ডব্লিউসিসিইউ-এর পরিচালক সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের ফলে বাংলাদেশে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে কচ্ছপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রজাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, কচ্ছপ পাচার বন্ধে দেশের মানুষের সমর্থন প্রয়োজন। নাহলে এই প্রজাতিগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ব্যানার ছবি: Pangshura tecta, Morenia peters এবং Lissemys punctata প্রজাতির জব্দ করা জীবন্ত কচ্ছপগুলিকে বন বিভাগের ঘেরে প্রথমে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। পরে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছবি: সাদিকুর রহমান
সাইটেশন
Das, I. (1990). The trade in freshwater turtles from Bangladesh. Oryx. 24. 163 – 166. doi:10.1017/S0030605300033895
Shamsurrahman, M., Mamun, A., Rahman, M., Hossain, M. B., Minar, M. H., Maheen, N. J. (2013). Illegal Marketing of Freshwater Turtles and Tortoises in Different Markets of Bangladesh. American-Eurasian Journal of Scientific Research 8(1): 15-23. doi:10.5829/idosi.aejsr.2013.8.1.66124
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল এ, ২০২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি।