- সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে মেছোবিড়াল উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা গেছে।
- এই স্থানগুলো মানব বসতি এবং বাণিজ্যিক মাছ চাষের এলাকার কাছাকাছি হওয়ায়, প্রজাতিটি হরহামেশাই প্রতিশোধমূলক হত্যা এবং সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
- হত্যা প্রতিরোধে ব্যাপক পরিসরে সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, গবেষক এবং সংরক্ষণবিদরা। পাশাপাশি, উপযুক্ত আবাসস্থল এবং মেছোবিড়াল চলাচলের পথ সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সংরক্ষিত এলাকার বাইরে, টিকে থাকার লড়াই করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পশু মেছোবিড়াল (Prionailurus viverrinus) — সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে। বিশ্বজুড়ে দ্রুত সংখ্যা কমে যাওয়ায়, International Union for Conservation of Nature (IUCN) এর রেড লিস্টে প্রজাতিটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত গবেষণাটি, দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষিত এলাকার বাইরে মেছোবিড়াল উপস্থিতি যাচাই এর লক্ষ্যে করা হয়েছিল। মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-কে গবেষণার প্রধান লেখক সম্রাট চক্রবর্তী বলেন, “মেছোবিড়ালের এখন পর্যন্ত টিকে থাকা শক্ত ঘাঁটি বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গকে। দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামীণ ও শহুরে জলাভূমি অঞ্চল নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি। এ অঞ্চলের পরিধি ৬৭ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি।”
গবেষক দলটি ১০টি জেলায় ৩৮টি স্থানে ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়ে ২৪টি এলাকায় মেছোবিড়ালের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে।
সম্রাট চক্রবর্তী জানান, “এই ২৪টি এলাকার মধ্যে ১৭টি আগে কখনও এদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল না। এর সবগুলোই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে অবস্থিত। এরমধ্যে আবার প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা মানুষের বসতির একেবারে পাশে, যেখানে পুকুরে মাছ চাষ হয়। বাকি ৪০ শতাংশ ‘ভেরি’ নামে পরিচিত বাণিজ্যিক মাছ চাষ কেন্দ্রের কাছে বসবাস করে।”
মানব বসতির এত কাছে থাকায় এরা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ২০২২ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মেছোবিড়ালের মৃত্যু মূলত প্রতিশোধমূলক হত্যা ও সড়ক দুর্ঘটনার কারণে হয়েছে।
গবেষণাটির হিসাব বলছে, এই অঞ্চলে প্রজাতিটির বসবাসের জন্য যেসব জায়গা উপযুক্ত, তার প্রায় ৮৮ শতাংশই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে।

সড়কই সবচেয়ে বড় হুমকি
ব্যারাকপুরে বেড়ে ওঠা চক্রবর্তীর মনে আছে, স্কুলজীবনে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে মেছোবিড়াল মারা যাওয়ার ঘটনা। এরকম অন্তত তিন-চারটি ঘটনা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন।
তিনি বলেন, “বর্তমানে সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনায় এদের মৃত্যু। নতুন নতুন হাইওয়ে প্রজাতিটির আবাসস্থলগুলোকে আলাদা করে দিচ্ছে। একারণে বেড়েছে এমন ঘটনার সংখ্যা।”
সবচেয়ে বেশি মেছোবিড়ালের মৃত্যু ঘটেছে হাওড়ায়। এ এলাকায় গত এক দশকে এমন ৭৭টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
হাওড়ার পশু উদ্ধারকর্মী চিত্রক প্রামাণিক জানান, মোটামুটি হিসাবে গত তিন-চার বছরে হাওড়ায় কমপক্ষে ৭০টি মেছোবিড়াল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
চক্রবর্তী বলেন, “এ ধরনের দুর্ঘটনা কমাতে, আমরা সড়কে যানবাহনের গতি কমানোর প্রস্তাব দিয়েছি। সেইসঙ্গে সিসিটিভি বসানোর কথা বলেছি এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় টহল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পিডব্লিউডি, পুলিশ ও সড়ক বিভাগের মতো অনেক সংস্থা জড়িত থাকায় এগুলো বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন।”
নামেই লুকিয়ে আছে বিপদ?
রাজ্যের অনেক মেছোবিড়াল, বিশেষ করে যারা মানুষের কাছাকাছি থাকে — তারা প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হয়েছে। চক্রবর্তীর মতে, এর প্রধান কারণ তাদের স্থানীয় নাম ‘বাঘরোল’।
তিনি বলেন, “বাংলায় বাঘরোল শব্দটি এসেছে, তাদের গায়ের ডোরাকাটা দাগ থেকে। এই দাগ বাঘের শরীরের দাগের মতো। ফলে অনেকে ভুল করে তাদের বাঘ বা বাঘ শাবক মনে করে এবং ভয় পেয়ে হত্যা করে। অথচ মানুষের ওপর মেছোবিড়াল আক্রমণের কোনও রেকর্ড নেই।”
এই ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে, তাদের নতুন নাম ‘মেছোবিড়াল’ দেওয়ার প্রচারণা চালানো হয়েছে। এর অর্থ ‘মাছ খাওয়া বিড়াল’।

চক্রবর্তী জানান, তারা বোর্ডে এই নাম ব্যবহার করছেন এবং সভাগুলোতেও মানুষকে তা জানাচ্ছেন। বন দপ্তরও এই শব্দ ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। ফলে মানুষ এখন কথাবার্তায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বাঘরোল’ শব্দটি কম ব্যবহার করছে। নাম পরিবর্তনের পর থেকে প্রতিশোধমূলক হত্যাও কিছুটা কমেছে।
তবে খাদ্যাভ্যাসের কারণেও এই বিড়ালদের হত্যা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, “প্রজাতিটির প্রধান খাদ্য মাছ। ফলে এরা জেলেদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যেকারণে জেলেরা মাঝে মাঝে এদের মেরে ফেলার চেষ্টা করে। মাছ না পেলে এই বিড়াল হাঁস-মুরগি ধরতে গ্রামে ঢোকে। এতেও মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।”
তিনি আরও জানান, হত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে বোর্ড ও ব্যানার লাগানো হয়েছে। এসব বোর্ডে লেখা থাকে, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন ১৯৭২ অনুযায়ী তফসিল ১-এর অন্তর্ভুক্ত মেছোবিড়াল এবং তাদের হত্যা করলে ১০ বছরের জেল বা ৩০ হাজার রুপি জরিমানা বা দুটোই হতে পারে।
মেছোবিড়াল হত্যার আরেকটি কারণ, ঐতিহ্যবাহী শিকার উৎসব। দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে এমন উৎসবে নানান ধরনের পাখি, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ীসহ মেছোবিড়ালও শিকার করা হতো। Human & Environment Alliance League (HEAL) নামের একটি সংস্থা এ বিষয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে। ২০১৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে এই শিকার নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে তারা। এরপর থেকে বেশ কয়েকটি জেলায় এই উৎসব বন্ধ হয়েছে।
উপযুক্ত আবাসস্থল
গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা (২৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ), পূর্ব মেদিনীপুর (১৮ দশমিক ০৭ শতাংশ) এবং নদীয়া (১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ) মেছোবিড়াল নামক এই বিড়াল প্রজাতির সবচেয়ে উপযুক্ত আবাসস্থল।
এতে আরও দেখা গেছে, আগে সম্ভাব্য আবাসস্থল মনে করা হলেও হাওড়া (৬ দশমিক ১৭ শতাংশ) ও হুগলি (৪ দশমিক ০৩ শতাংশ) আবাসস্থল হিসেবে তুলনামূলকভাবে কম উপযুক্ত এলাকা ।
হাওড়ার বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দীপক মণ্ডল বলেন, “হাওড়ায় মেছোবিড়ালের সংখ্যা ভালো। তবে সংখ্যা নির্ধারণে এখনো কোনও সরকারি শুমারি হয়নি।
হাওড়ায় মেছোবিড়াল শুমারির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-কে জানান তিনি।
চক্রবর্তী বলেন, “বর্তমানে কলকাতায় মেছোবিড়ালের আর কোনও উপযুক্ত আবাসস্থল নেই। ১৯৯২ সালে একটি গবেষণায় কলকাতাকে ‘বিড়ালের দেশ’ বলা হয়েছিল। কারণ তখন অনেক প্রজাতির বিড়াল এখানে ছিল। কিন্তু শহর দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায়, ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে যায়। ফলে এদের সম্ভাব্য আবাসস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং গত ৩০ বছরে বিড়ালরা শহরের বাইরে হাওড়ার মতো এলাকার দিকে সরে গেছে।”
প্রামাণিক বলেন, “হাওড়ায় এখনও মেছোবিড়ালের সংখ্যা অনেক। হাওড়া শব্দটি এসেছে ‘হাওর’ থেকে, যার অর্থ জলাভূমিতে ভরা হ্রদ। বাগনান, আমতা, শ্যামপুর, উলুবেড়িয়া ইত্যাদি গ্রামীণ এলাকায় অনেক মেছোবিড়াল দেখা যায়।”

তিনি জানান, গত নয় বছরে তিনি এবং তাঁর দলের ছয়জন বন্ধু ৫০টির বেশি মেছোবিড়াল উদ্ধার করেছেন।
২০২২ সালের এক ঘটনার কথা বলেন তিনি— বাগনানের দুই জেলে, তিনটি মা মেছোবিড়ালকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে। এই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। অপরাধীরা পালিয়ে যায় এবং পরে আগাম জামিন নিতে হয় তাদের। এতে করে মানুষ বুঝতে পারে যে মেছোবিড়াল হত্যা করলে জেল হতে পারে। তারপর থেকে হাওড়ায় আর প্রতিশোধমূলক হত্যা হয়নি।
তবে হাওড়ায় মেছোবিড়ালের জন্য এখন নতুন হুমকি, শূকর। তিনি বলেন, “প্রায় ১৫ বছর আগে সোয়াইন ফ্লু প্রাদুর্ভাবের পর, সরকার শূকর খামারিদেরকে শূকর মেরে ফেলতে বা সুন্দরবনে ছেড়ে দিতে বলেছিল। তবে খামারিরা তাদের হাওড়ার মতো এলাকায় ছেড়ে দেয়। ফলে তারা দ্রুত বংশবিস্তার করে এখন এলাকার ফসল নষ্ট করছে। মানুষ তাদের মারার জন্য তারের ফাঁদ বসাচ্ছে। এতে মেছোবিড়ালসহ অন্য প্রাণীও আটকা পড়ছে।”
দ্রুত নগরায়ণ হওয়া হাওড়ায়, দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে প্রজাতিটির আবাসস্থল। তাই প্রামাণিক ও তার দল দামোদর নদীর তীরে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অক্ষত বনভূমি চিহ্নিত করেছে। এলাকাটিকে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “এখনও পর্যন্ত এই বনে কোনও অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। নিকটতম গ্রামও এক কিলোমিটার দূরে। এখানে মেছোবিড়াল, বন-বিড়াল, সোনালী শৃগাল, এশিয়ান পাম সিভেট, শজারু, মঙ্গুস, সাপ, কচ্ছপসহ অনেক প্রাণী রয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে অনুরোধ করেছি, এই অঞ্চলকে জীববৈচিত্র্য অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে। বর্তমানে উদ্ধার করা প্রাণীদের আমরা এই বনেই ছেড়ে দেই।”
প্রস্তাবটি বিবেচনাধীন আছে বলে জানান, ডিএফও মণ্ডল।
গবেষণার উপসংহারে বলা হয়, শুধুমাত্র সংরক্ষিত এলাকাগুলো মেছোবিড়ালের দীর্ঘমেয়াদী বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। এতে আরও বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য তুলনামূলক উপযুক্ত আবাসস্থল এবং মেছোবিড়াল চলাচলের সম্ভাব্য পথগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রজাতিটির সম্পর্কে সচেতনতা আরও বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যানার ছবি: বনগাঁয় গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়া একটি মেছোবিড়াল। ছবি: সম্রাট চক্রবর্তী।
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-তে (https://india.mongabay.com/) ,২০২৫ সালের ৩১ মার্চ।