- সম্প্রতি সফলভাবে লোটাস সিল্ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। পদ্ম ফুলের ডাঁটা থেকে তৈরি এক ধরনের পরিবেশবান্ধব বিলাসবহুল তন্তু হল এই সিল্ক। ঐতিহ্য আর টেকসই প্রযুক্তির সমন্বয়ে উৎপাদিত হচ্ছে এই বিশেষ কাপড়।
- প্রচলিত কাপড়ের মতো লোটাস সিল্ক উৎপাদনে লাগে না পানি, রাসায়নিক পদার্থ কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানি। ফলে এটি এ সময়ে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ বান্ধব পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
- চড়া দামের এই কাপড় এরই মধ্যে বিশ্বের নামীদামী ফ্যাশন হাউজগুলোর নজর কেড়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য নৈতিক ফ্যাশন (যে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশ, মানুষ ও পশু পাখির কম ক্ষতি হয়, তাকে নৈতিক ফ্যাশন বলে) বাজারে একটি ভালো অবস্থান এনে দিতে পারে।
- দেশের কয়েকটি গ্রামে লোটাস সিল্ক উৎপাদন, নারীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের পথ খুলেছে। আন্তর্জাতিক মূলবান এই পণ্যের উৎপাদনে তারা হয়ে উঠছেন দক্ষ; একই সঙ্গে নতুন জীবন পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রাচীন হস্তশিল্প ঐতিহ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলা ও টেকসই বিকল্প পণ্য নিয়ে বিশ্বভাবনার সময়ে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন লোটাস সিল্ক। যা পদ্মফুলের (Nelumbo nucifera) ডাঁটা থেকে তৈরি। বিরল ও বিলাসবহুল এই কাপড় সহজেই মিশে যায় মাটির সঙ্গে।
বাংলাদেশে এই প্রথম উৎপাদিত লোটাস সিল্ক একদিকে যেমন ধারণ করছে আদি ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিক পরিবেশবান্ধব এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে, গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথও দেখাচ্ছে এটি।
প্রাচীন সংস্কৃতিতে বিশুদ্ধতার প্রতীক পদ্ম ফুল, এখন সবচেয়ে দূষণকারী পোশাক শিল্পের জন্য নিয়ে এসেছে বাস্তবিক সমাধান। কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামের মতো দেশে বহুদিন ধরে লোটাস সিল্ক তৈরি হচ্ছে। নরম, বাতাস চলাচলযোগ্য, ভাজ পড়েনা বলে এই কাপড়কে অনেকেই প্রাকৃতিক সিল্ক আর লিনেনের এক অনন্য মিশ্রণ বলে মনে করেন।
বাংলাদেশে লোটাস তন্তু উৎপাদনের পথিকৃৎ বেঙ্গল প্ল্যান্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিপিআরডি)। ২০২১ সালে এই প্রতিষ্ঠান পদ্মের বৈচিত্র্য, ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করার সময়ে এর ডাঁটা থেকে তন্তু তৈরির ধারণাটি পায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থ ও সহায়তা দেয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো।
বিপিআরডির চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক শিকদার আবুল কাশেম শামসুদ্দিন বলেন, “এটি শুধু বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ। সনাতন কাল থেকে পদ্ম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ ছিলো, যা এখন টেকসই ভবিষ্যতের অংশও।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-গবেষক রাখা হরি সরকার বলেন, “পদ্মের ডাঁটায় প্রাকৃতিক সূক্ষ্ম তন্তু আছে, যা কম খরচে উচ্চমূল্যের তন্তুতে রূপান্তর করা যায়। এটি প্রাকৃতিক, টেকসই এবং সর্বোপরি আমাদের নিজস্ব সম্পদ।”

ঐতিহ্যের শেকড়েই আছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
প্রচলিত প্রক্রিয়ায় কাপড় উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ, রাসায়নিক রং ও বিপুল পানি। কিন্তু বাংলাদেশের লোটাস সিল্ক উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব। পরিবেশে এর নেতিবাচক প্রভাব নেই বললেই চলে।
দেশের বিভিন্ন জলাভূমি থেকে গাছ উপড়ে ফেলা ছাড়াই খুব সতর্কভাবে পদ্ম ফুলের ডাঁটা সংগ্রহ করা হয়। শেকড়সহ তোলা হয়না বলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং বাকি অংশ থেকে নতুন কাণ্ড দ্রুত বেড়ে ওঠে।
শামসুদ্দিন বলেন, “আমরা গাছের ক্ষতি না করেই ডাঁটা সংগ্রহ করি। এতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন পাতা ও ডাঁটা জন্মায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটি টেকসই প্রক্রিয়া।”
ডাঁটার ভেতরে থাকা আঠালো তন্তুগুলো বাতাসে আসা মাত্র সূক্ষ্ম সুতায় পরিণত হয়। এরপর সেগুলো পাকানো হয় খালি হাতে, শুকানো হয় প্রাকৃতিকভাবে এবং হাতের তাঁতে বোনা হয় কাপড়।
এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের মাত্রা শূন্য। নেই পানি, রাসায়নিক কিংবা পরিবেশের ক্ষতিকর কোনো উপাদানের ব্যবহার। লাগেনা জীবাশ্ম জ্বালানি। ফলে এটি আজকের দিনে সবচেয়ে টেকসই পরিবেশবান্ধব কাপড়ের মধ্যে একটি।
এদিকে উৎপাদন পরবর্তী ফেলে দেয়া অংশ থেকে তৈরি হয়না বর্জ্য। উল্টো তা জৈব সার বা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা প্রতিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত করে মজবুত অর্থনীতির ভিত তৈরি করে।

বুনন ঐহিত্যে নতুন প্রাণ ও প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন
পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি লোটাস সিল্ক, বাংলাদেশের বুনন ঐতিহ্যে নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ নারী ও কারিগরদের জন্য খুলে দিয়েছে নতুন জীবিকার দরজা।
ফরিদপুর জেলার রংকইল গ্রামে লোটাস সুতার কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে নারীদের। এতে নিম্নআয়ের পরিবারে যোগ হচ্ছে নতুন অর্থ সংস্থান, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছেন নারীরা।
শামসুদ্দিন বলেন, “এটি শুধু বস্ত্র নয়—জীবন যাপনে যোগ করছে নতুন মাত্রা। যারা কোনোদিন কল্পনাও করেনি বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যের শিল্পে কাজ করবে, তারাই এখন প্রিমিয়াম কাপড়ের দক্ষ কারিগর।”
এই প্রক্রিয়ায় দরকার সুক্ষ হাতের কাজ ও নিখুঁত কারিগরি দক্ষতা। যা বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবেই বুনন শিল্পের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। চাহিদা বাড়তে থাকলে লোটাস সিল্ক শিল্প, জলাভূমি এলাকায় টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে এবং পদ্ম ফুলের আবাসস্থল সংরক্ষণের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে।
শামসুদ্দীন বলেন, “বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এখানে খাল-বিল, নদী, ও হাওর-বাওরের মতো জলাশয় আছে। এসব জলাভূমির মধ্যে বড় বড় বিলে প্রতিবছর পদ্ম ফুল ফোঁটে। যদি আমরা প্রাকৃতিকভাবে লোটাস সিল্কের মূল উপাদান পেতে চাই, তাহলে এই জলাভূমিগুলো আমাদের সংরক্ষণ করা জরুরী।”

বিশ্ববাজারে এই সিল্কের আবেদন
আন্তর্জাতিকভাবে লোটাস সিল্ক এরইমধ্যে উৎকৃষ্ট মানের পরিবেশবান্ধব কাপড় হিসেবে নজর কেড়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, ইতালির বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউস লোরো পিয়ানা (Loro Piana) লোটাস সিল্কের বিশেষ পোশাক এনেছে বাজারে। এর মধ্যে রয়েছে জ্যাকেট, যার দাম প্রায় ৫,৬০০ ডলার বা ৬৮০,০০০ টাকা।
ভারতে এক পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হাইড্রোফোবিক ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে দাগ–প্রতিরোধী, টেকসই ও ভাজহীন (No Mark) লোটাস শার্ট তৈরি করেছে।
কম্বোডিয়ায় ইউনেস্কো পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্র্যান্ড স্যামোটা (Samota) দেখিয়েছে, কীভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে নারী উদ্যোগ, পদ্ম তন্তুকে বিশ্ববাজারের চাহিদাসম্পন্ন নৈতিক ফ্যাশন পণ্যে রূপান্তর করতে পারে।
এসব সাফল্যের গল্প বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে আশার পথ দেখাচ্ছে। শামসুদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশের আছে প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রমিক আর এখন এ সম্পর্কিত জ্ঞানও।
প্রায়োগিক পরিকল্পনা, গবেষণা, টেকসই উপায়ে লোটাস সংগ্রহ ও পরিবেশবান্ধব রঙের প্রয়োগ, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতিবান্ধব বিলাসবহুল এই পণ্যের সঙ্গে আমাদের নাম যুক্ত করতে পারি।”
লোটাস সিল্কের দাম প্রতি কেজি আড়াই হাজার ডলার (৩০৪০০০টাকা) থেকে চার হাজার ডলার (৪৮৬,০০০ টাকা)। পদ্ম ফুল ভরা জলাভূমি ও দক্ষ কর্মী নিয়ে, লোটাস সিল্কের বাজারে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে বড় নাম।
গবেষকরা জানান, লোটাস সিল্ক মূলত লোটাস গাছের মূলে থাকা বিশেষ ধরনের সেলুলোজ থেকে তৈরি। এই সেলুলোজের পরিমাণ নির্ভর করে, গাছ যেখানে বেড়ে উঠছে সেখানকার পানির গভীরতার ওপর।
শামসুদ্দিন বলেন, সেলুলোজের মান ও পরিমাণ বাড়াতে আধুনিক উদ্ভিদ প্রজনন, কোষ ও টিস্যু কালচার এবং উদ্ভিদ জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
লোটাস সিল্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সারাবিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে, তখন লোটাস সিল্ক বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি সাধারণ কাপড় নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য টেকসই ভবিষ্যতের বড় সুযোগ।
“সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও সচেতনতা থাকলে লোটাস সিল্ক টেকসই উদ্ভাবনের একটি শীর্ষ স্থান হতে পারে,” বলেন শামসুদ্দিন। “এটি শুধুমাত্র কাপড় নয়, একটি জাতীয় সুযোগ,” যোগ করেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাক শিল্পের বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতেই আছে।
নতুন করে এই লোটাস সিল্ক, টেকসই ফ্যাশনের ভবিষ্যত বাজারে নিজেদের জায়গা করে নেয়ার সুযোগও দিচ্ছে দেশটির সামনে।

ব্যানার ছবি: বাংলাদেশের জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে জন্মে পদ্ম ফুল। ছবি: Image by NEOSiAM 2024+ via Pexels (Public domain).
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল।