- বেশ কিছু বিপন্নসহ অবৈধভাবে পালন ও প্রদর্শন করায়, সম্প্রতি এক অভিযানে অন্তত ৪৮টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। গত ৮ এপ্রিল ময়মনসিংহের একটি মিনি চিড়িয়াখানা থেকে এদের উদ্ধার করে তারা।
- আঁটসাট খাঁচায় ভিষণ দুর্বল অবস্থায় পাওয়া যায় এদের। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, চোরাকারবারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এই প্রাণীগুলো ।
- উদ্ধারের পর সাফারি ও ইকো পার্কে পুনর্বাসনের জন্য নেয়া হয় এদের। তবে বেশ কয়েকটিকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয় বনে। উদ্ধার থেকে পুনর্বাসন, পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করেছে বনবিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ কন্ট্রোল ইউনিট (ডাব্লিউসিসিইউ)।
- বনবিভাগের এই দলটি বন্যপ্রাণী রক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও, প্রাণীগুলো উদ্ধার পরবর্তী যত্নে স্থানীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রের সক্ষমতা না থাকায়, অভিযানের সুফল আসবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। দুর্বল অবকাঠামো ছাড়াও এসব কেন্দ্রে বন্যপ্রাণীদের সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা সহায়তা অপ্রতুল।
গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের উত্তর-মধ্যবর্তী অঞ্চল ময়মনসিংহের একটি অবৈধ মিনি চিড়িয়াখানা থেকে ৪৮টি প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে এশিয় কৃষ্ণ ভাল্লুক (Ursus thibetanus), মদনটাক পাখি (Leptoptilos javanicus) ও লজ্জাবতী বানরের (Nycticebus bengalensis) মত বিপন্নপ্রাণী । উদ্ধারের সময় খাঁচায় বন্দী এসব প্রাণী শারীরীকভাবে ভিষন দুর্বল ছিলো।
বনবিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ কন্ট্রোল ইউনিট (ডাব্লিউসিসিইউ), রাজধানী ঢাকা থেকে ১২৪ কিলোমিটার দূরে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত ওই চিড়িয়াখানাটিতে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে। নেতৃত্ব দেন বনবিভাগের কর্মকর্তা নারগিস সুলতানা। তাকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা।
উদ্ধার অভিযানের সময় সেখানে এই প্রাণীগুলো কেমন অবস্থায় ছিলো, মঙ্গাবে-কে নারগিস তা বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন এশিয় কৃষ্ণ ভাল্লুকটি ছিলো গুরুতর আহত। অন্যান্য প্রাণীদের যেসব খাবার দেয়া হয়েছিলো, সেগুলো ছিলো পঁচা-বাসি। এছাড়া খুব চাপাচাপি করে খাঁচা ভর্তি করে রাখা হয়েছিলো প্রানীগুলোকে, যোগ করেন নারগিস।
”সন্দেহ করা হচ্ছে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে এক দশকেরও বেশি আগে, অধিকাংশ বন্যপ্রাণীকেই এই অবৈধ চিড়িয়াখানাটিতে আনা হয়। সে সময় তারা অনেক ছোট ছিলো। সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে তারা ,কিন্তু বড় হয়নি খাঁচার মাপ,” মঙ্গাবে-কে বলেন নারগিস।
২০১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ডাব্লিউসিসিইউ বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় কাজ করছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর আওতায়, শিকারী ও পাচারকারীদের হাত থেকে বন্যপ্রাণী বাঁচাতে স্বেচ্ছাসেবক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রয়েছে নিরন্তর প্রচেষ্টা।
তবে লম্বা সময় ধরে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী সংগ্রহ ও পালনকে প্রশ্রয় দিয়ে আসায় নিয়ন্ত্রণে ছিলোনা রক্ষণাবেক্ষণ। গত বছর আগস্টে স্বৈরাচারী শাসন অবসানের পর বদলেছে পরিস্থিতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে দূরে অবস্থান, তবু বন্যপ্রাণী ব্যক্তিগতভাবে পালন করছে কিংবা সংগ্রহশালা রয়েছে এরকম বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালিয়েছে বনবিভাগ। উদ্ধার করেছে সেখানকার প্রাণীদের।
নিয়মিত এসব বন্যপ্রাণী অভিযানে প্রশংসায় ভেসেছে ডাব্লিউসিসিইউ। তবে উদ্ধার করা প্রানীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাচ্ছে না উদ্বেগ। বনবিভাগের কর্মকর্তারা প্রাণীগুলো দেখে-বুঝে উপযুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দিয়েছে। আবার অনেকগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য পাঠিয়েছে গাজীপুর কিংবা ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে।


উদ্ধারের পর চাই সক্ষম পুনর্বাসন ব্যবস্থা
২০২৪ এর আগস্ট থেকে এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত অবৈধ ব্যবস্থাপনা থেকে অন্তত ৩৩৬টি প্রাণী উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। দিনাজপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর ও শরীয়তপুর জেলা এবং পার্বত্য জেলা রাঙামাটি থেকে উদ্ধার করা হয় এসব প্রাণী।
এসব প্রাণীর মূল আবাসস্থল ছিলো দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেমন কৃষ্ণ ভাল্লুক, মুখপোড়া হনুমান (Trachypithecus pileatus), সাম্বার হরিণ (Rusa unicolor), লজ্জাবতী বানর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার প্রাণী।
এদিকে সুন্দরবনে এখনো দেখা মেলে চিত্রা হরিণ (Axis axis) ও বন বিড়ালের (Prionailurus bengalensis)। এছাড়া সারাদেশের জলাভূমি, প্লাবনভূমি, নদী ও সংলগ্ন এলাকায় পাওয়া যায় পানির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এমন প্রাণী, যেমন উদবেড়াল (Lutra lutra), ইন্ডিয়ান সজারু (Hystrix indica), মুগার কুমির (Crocodylus palustris)ও দেশি কড়ি কাছিম (Pangshura tecta)।
২০১৫ সালের আইইউসিএন রেড লিস্ট অনুযায়ী, চিত্রা হরিণ ও দেশি কড়ি কাছিম ছাড়া উল্লেখিত সব প্রাণীগুলোকেই হয় বিপন্ন, মহাবিপন্ন অথবা সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ওই চিড়িয়াখানায় অভিযানের পরদিনই ৯ এপ্রিল আবারো মাঠে নামে বন্যপ্রাণী কর্মকর্তা নারগিস ও তার দল। উত্তরবঙ্গের শেরপুর জেলায় এক অবৈধ চিড়িয়াখানা থেকে শেয়াল (Vulpes Bengalensis), গন্ধগোকুল (Paradoxurus Hermaphroditus), ইন্ডিয়ান অজগরসহ (Python Molurus) ১৭ টি প্রাণী উদ্ধার করেন তারা। এছাড়া অল্প কিছু রেশাস বানর (Macaca mulatta) এবং চিত্রা হরিণও ছিলো উদ্ধার তালিকায়। শেরপুর থেকে উদ্ধার করা অজগর আর বানরগুলোকে দ্রুত মধুটিলা ইকো পার্কে অবমুক্ত করা হয়। আগের দিন ময়মনসিংহে উদ্ধার করা ৪৮টি প্রাণীর মধ্যে, সাপ ও বানরদের পাঠানো হয় গাজীপুর সাফারি পার্কে। এদের মধ্যে কোনোটিই বনে স্বাভাবিক পরিবেশে টিকে থাকার মত অবস্থায় ছিলো না বলে জানান নারগিস।
আইইউসিনের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে বেড়ে ওঠা যে কোনো বন্যপ্রাণী আবার বনে ফেরানোর আগে, নিবির ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি এড়াতেই এই ব্যবস্থা।
উদ্ধারের পর বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, প্রাণীগুলো ভিষন দুর্বল থাক। বেঁচে থাকার ক্ষমতাও কমে আসে তাদের। ফলে প্রায়ই তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি দেখা যায়। বন্দী অবস্থায় নানা রকম রোগ-ব্যাধির সংক্রমণও নিয়ে আসে এসব প্রাণী। ফলে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া বনে ছাড়া হয়না তাদের। তাছাড়া বিরতি দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী নাও থাকতে পারে এসব প্রাণী। বনে ছেড়ে দেয়া হলে তারা হয়ে উঠতে পারে আক্রমণাত্মক, ঝুঁকিতে পড়তে পারে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য। এর বাইরে রোগাক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে পড়ে অসুস্থ্য হতে পারে অন্য প্রাণীও। আর যদি এরকম হয়, রোগাক্রান্ত প্রাণীটির আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তাহলে তাকে ব্যথামুক্ত জীবনাবসানের কথাও বলা হয়েছে আইউসিএনের নির্দেশনায়।

প্রাণী পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর বর্তমান অবস্থা
ডাব্লিউসিসিইউ কর্তৃপক্ষ বলছে, আইইউসিএনের নির্দেশনা সম্পর্ক অবগত তারা। তাই স্বপ্নপুরী থেকে ভাল্লুকটিকে উদ্ধারের পরপরই এটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে দিনাজপুর থেকে ২৮৫ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সাফারি পার্কে পাঠানো হয়, জানান বনবিভাগের আরেক কর্মকর্তা ও উদ্ধারকারী দলের সদস্য আবদুল্লাহ আস সাদেক। যদিও চিকিৎসক থাকার নিশ্চয়তা থাকলে তারা ভাল্লুকটিকে আরো কাছে ১৭০ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীতে বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে পারতেন। বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক বন্যপ্রাণী নিরাপত্তা প্রকল্পের (এসআরসিডব্লিউপি) আওতায় এই পুনার্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
“অসুস্থ প্রাণীগুলোকে একসঙ্গে একটি খাঁচায় চিকিৎসা দিতে হয় আমাদের। অন্য খাঁচাগুলো পরিত্যক্ত,” বললেন আরেক বন্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির।
খুলনা বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অবস্থাও একই রকম। এই কেন্দ্রটিও এসআরসিডব্লিউপি প্রকল্পের অধীনে নির্মিত।
“সম্প্রতি একটি উদ্ধার করা কুমির এখানে আনা হয়েছিল, কিন্তু পশু চিকিৎসক না থাকায় আমরা তার প্রয়োজনীয় যত্ন দিতে পারিনি,” জানালেন বন বিভাগের কর্মী মোফিজুর রহমান চৌধুরী।
বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের আওতায় নির্মিত আরেকটি বন্যপ্রাণী উদ্ধার উদ্যোগ, সিলেট জেলার মৌলভীবাজারের জানকিছড়া কেন্দ্র। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল এটি। ২০২১ সালে জার্মান ভিত্তিক লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণ সংস্থা প্লাম্পলরিসের বাংলাদেশ শাখা ও ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স মিলে এই কেন্দ্রের কিছু খাঁচা সংস্কার করে।
বিপন্ন লজ্জাবতী বানর ও মুখপোড়া হনুমানের পুনর্বাসনের জন্য বন বিভাগ এই দুটি সংরক্ষণ সংস্থার কাছে প্রাণীগুলো হস্তান্তর করে।
বাংলাদেশে লজ্জাবতী বানরের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও প্রাইমাটোলজিস্ট হাসান আল রাজি চয়ন জানান, কীভাবে তার ১৭ সদস্যের দল উদ্ধার করা বানরগুলোর যত্ন নেন।
চূড়ান্ত অবমুক্তির আগে তার দল চিকিৎসা শেষ হয়েছে এমন প্রাণীগুলোকে, একটি আধা-প্রাকৃতিক খাঁচায় রাখেন। “ওখানে তারা নিজেরাই কীভাবে খাবার খুঁজে খেতে হয় ও বনে টিকে থাকতে হয়, তা শেখে,” বলেন চয়ন। তিনি উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি বন্যপ্রাণী অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সরবরাহ করা খাবারের ওপর।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে অবশ্যই উদ্ধার, সুস্থ করে তোলা, পুনর্বাসন, অবমুক্তি ও গবেষণার মত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
গবেষণার অংশ হিসেবে অবমুক্ত করা প্রাণীগুলোর গলায় রেডিও কলার লাগিয়ে দেয় গবেষকরা, যাতে তাদের চলাফেরা ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়।
চয়ন আরও বলেন, দক্ষ জনবলসহ একটি আলাদা ইউনিট গঠন করতে পারে বনবিভাগ, যারা বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসনের কাজ করবে। “উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা শিক্ষামূলক কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে,” যোগ করেন তিনি।

কর্তৃপক্ষ যা করছে
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মঙ্গাবে-কে জানান, ”আমাদের দুর্বলতা স্বীকার করছি, একই সঙ্গে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়াতেও কাজ করছি আমরা। যেনো সাফারি পার্কসহ এই কেন্দ্রগুলো, দুর্দশাগ্রস্ত বন্য প্রাণীদের সেবা দিতে পারে।”
“আমরা পরিককল্পনা কমিশন থেকে দেশের সব ব্যক্তিমালিকানায় থাকা হাতি পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছি,” বলেও জানান রিজওয়ানা। আইইউসিএনের তথ্য মতে বাংলাদেশে বিনোদনসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ৯৪ টি এশিয় হাতি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
রিজওয়ানা বলেন, রিং-টেইলড লেমুরের মতো বিদেশী বন্যপ্রাণীও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আনা হয়েছে, সেগুলো জব্দ করে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার কাজও করছে সরকার।
ব্যানার ছবি: একটি কৃত্রিম পার্ক থেকে হরিণ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী দল। ছবি: ডাব্লিউসিসিইউ
সাইটেশন:
Islam, M. Z. (2022). The role of law in conserving wildlife in Bangladesh. International Journal of Environmental Studies. 80(4):1-10. doi:10.1080/00207233.2022.2103998
Pyke, G. H., & Szabo, J. K. (2017). Conservation and the four Rs, which are rescue, rehabilitation, release, and research. Conservation Biology. doi:10.1111/cobi.12937
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৫ সালের ৬ মে।