- বন সংরক্ষণ জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ গুচ্ছবন, প্রাচীন বৃক্ষ এবং সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য উদ্ভিদের একটি তালিকা তৈরি করছে।
- দেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও সুরক্ষা) আইনে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও এ খণ্ডিত বনভূমিগুলোর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত ছিল। অবশেষে বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে।
- সংরক্ষণবাদীরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের বিশ্বাস, নতুন পদক্ষেপগুলো অতীতে বিলুপ্ত হওয়া জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। প্রণয়ন করা হচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী, সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব গাছ ও গুচ্ছবনের তালিকা।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ গুচ্ছবনের সঙ্গে লোকায়ত বিশ্বাসের যোগসূত্র বিদ্যমান। গ্রামীণ জনপদের কোথাও কোথাও গাছপালা দৈব-নিরাপত্তা ও পূর্বপুরুষের আশীর্বাদের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। কোথাও বটগাছের নিচে নিত্য প্রদীপ জ্বলে, আবার কোথাও আমবাগানে গ্রাম্য দেবতার পূজা হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলমান এ বিশ্বাসই গড়ে তুলেছে এক অদৃশ্য সুরক্ষাবলয়, যেখানে গাছপালা, মানুষ এবং সংস্কৃতি একত্রে বেঁচে আছে।
এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয়দের কাছ থেকে শতবর্ষী বৃক্ষ ও লোকালয়ের মানুষের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত স্থানগুলোর অবস্থান ও বিবরণ সংগ্রহ শুরু করেছে, বন বিভাগ। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি, এ বিষয়ে একটি গণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকার।
বিজ্ঞপ্তিতে সাধারন মানুষের কাছ থেকে ৫০ বছরের বেশি বয়সী গাছ এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা লোকায়ত বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ছোট আকারের বনভূমি সম্পর্কিত তথ্য জানতে চেয়েছে সরকার।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, বাংলাদেশ জুড়ে থাকা অসংখ্য প্রাচীন বৃক্ষের কথা। এসব প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উঠে এসেছে বট ও আম গাছের নাম।
তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমরা এরইমধ্যে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। তবে সাধারন মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত পরিমাণে তথ্য পাওয়া যায়নি।”
পরিবেশ উপদেষ্টা আরও জানান, তথ্যের ঘাটতি থাকায় স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের প্রাচীন বৃক্ষ ও পবিত্র বলে বিবেচিত গুচ্ছবনের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে, যাতে এদের প্রোফাইল তৈরি করে সুরক্ষিত বা বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা যায়।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও সুরক্ষা) আইন ২০১২ এর নির্দেশনা অনুযায়ী- গুচ্ছবন, বয়স্ক গাছ এবং সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য উদ্ভিদ রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে যেহেতু বনভূমিগুলোর বেশিরভাগই ব্যক্তিগত জমি এবং এগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনগণের, এসব এলাকা ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা তৈরির কাজ করছে সরকার। সাধারনত, কোনো আইনের বিভিন্ন দিক কার্যকর করতে তার অধীনে একাধিক নীতিমালা ও বিধি প্রণয়ন করা হয়।
বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, এরইমধ্যে নিয়মাবলির খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত বনভূমিগুলোর ব্যবস্থাপনার কাজ করা হবে।
তিনি আরো জানান, খসড়া অনুযায়ী; ঘোষিত বনভূমি, প্রাচীন বৃক্ষ বা লোকায়ত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত বৃক্ষ ব্যবস্থাপনার কাজ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে একটি স্বেচ্ছাসেবী কমিটি পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশে এ ধরনের বনভূমির প্রাচুর্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে আবু নাসের মোহসিন হোসেন মঙ্গাবেকে বলেন, “বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ধরনের ছোট বনভূমি বা প্রাচীন বৃক্ষ সারা দেশেই দেখা যায় এবং এদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে এ ধরনের বনভূমি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামে (CHT)। সেখানে এদের Village Common Forest (VCF) বলা হয়।
Village Common Forest (VCF) আদিবাসী জনগোষ্ঠী দ্বারা রক্ষিত প্রাকৃতিক বন। এগুলো গ্রামাঞ্চলের চারপাশে বৃক্ষরাজি ও জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে, বন উজাড় রোধ করে এবং কাঠ ও বাঁশের টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত করে।
হোসেন আরও জানান, খসড়া নিয়ম অনুযায়ী; তুলনামূলকভাবে বৃহৎ বনভূমিকে (৫ একর বা ২ হেক্টরের বেশি) সুরক্ষিত ঘোষণা করা হবে। বাকিগুলো ‘বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। দীর্ঘদিন বন সংরক্ষণের কাজ করেছেন তিনি। সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি মঙ্গাবেকে বলেন, “এ উদ্যোগ দেশের বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ছোট বনভূমি তথা জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধ কেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।”

তিনি আরও বলেন, “প্রাচীন বৃক্ষগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। প্রতিটি প্রাচীন বৃক্ষের ছোট ছোট স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, ফার্ন, ছত্রাক ইত্যাদির আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।”
এ ধরনের বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, “যদি সংরক্ষণের কাজটি স্বেচ্ছাসেবী কাজ হিসেবেও করা হয়, সংরক্ষণ উদ্যোগগুলো পরিচালনার জন্য একটি বাজেটের প্রয়োজন হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিটি সংরক্ষণ এলাকার জন্য কার্বন পরিমাপের ব্যবস্থা করা, যাতে পরবর্তীতে তহবিল গঠনের জন্য তা ব্যবহার করা যায়।”
সংরক্ষণের অনুশীলন এবং সুবিধা
ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ধারণা বাংলাদেশে খুব যে নতুন, তা নয়। বিশেষত, পাখি রক্ষার ক্ষেত্রে দেশে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দ্বারা এর আগেও বেশ কিছু সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাস গড়ে তোলার উদাহরণ এ ধরনের সংরক্ষণের অন্যতম দৃষ্টান্ত।
পাশাপাশি, পার্বত্য চট্টগ্রামে মিঠা পানির উৎস সংরক্ষণে Village Common Forest রক্ষার উদ্যোগ আরেকটি ভালো উদাহরণ, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের।
এ ধরনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই স্থানীয়রা একত্রিত হয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং সেই কমিটিই সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও, গুচ্ছ বন ব্যবস্থাপনা বিশ্বজুড়ে একটি জনপ্রিয় অনুশীলন। ভারত, নেপাল ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের বনভূমি সংরক্ষণ করে আসছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ হেক্টর (৬৪ লাখ একর), যা দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০২৩ সালের এক গবেষণায় গুচ্ছবন সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও এসব বন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও লোকায়ত বিশ্বাস ছাড়াও অন্যান্য অনেক সুবিধা প্রদান করে।

গবেষণায় আরও বলা হয়, লোকায়ত বিশ্বাস এবং সামাজিক মূল্যবোধের যোগাযোগ থাকে বলে বন উজাড়ের হাত থেকে বেঁচে যায় এসব বন। ফলে বিরল ও স্থানীয় প্রজাতির গাছ ও প্রাণীর উপযুক্ত আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে এরা। যেকারণে দীর্ঘ সময় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সক্ষম হয় গুচ্ছবন। এসব বন বহু ঔষধি উদ্ভিদের উৎসস্থল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় আরও বলা হয়, যেহেতু এসব বন ও গাছপালা সাধারণত বন উজাড়ের হাত থেকে রক্ষা পায়, এরা স্থানীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে ভূমিকা রাখে।
ব্যানার ছবি: পবিত্র বলে বিবেচিত বটগাছের পূজা করে নারায়ণগঞ্জ জেলার স্থানীয়দের একাংশ। ছবি: মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান।
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৫ সালের ২৩ মে।