পাঁচটি বিরল প্রজাতির উদ্ভিদকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বন্য প্রতিবেশে উদ্ভিদের প্রজনন ক্ষমতা পুনর্গঠনের মাধ্যমে তাদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার এমন উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম।
বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদগুলো হলো — বাল্বোরক্স বা bulborox (Bulbophyllum roxburghii), ছোট-বাল্ব অর্কিড বা small-bulb orchid (Bulbophyllum oblongum), বনখেজুর বা dwarf date palm (Phoenix acaulis), চালমুগরা বা chaulmoogra (Hydnocarpus kurzii) এবং বাঁশপাতা বা bash pata (Podocarpus neriifolius).
২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো Plant Red List — এ উল্লিখিত উদ্ভিদগুলোকে ‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই তালিকায়, পাঁচটি উদ্ভিদগোষ্ঠী থেকে মোট এক হাজার প্রজাতির বিদ্যমান অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়। এর মধ্যে, ২৭১টি ‘সংকটাপন্ন নয়’; ২৫৬টি ‘তথ্যের অভাবযুক্ত’ ও ৩৯৫টি প্রজাতিকে ‘হুমকির মুখে’ রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। নিকট ভবিষ্যতে বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা এসব প্রজাতির মধ্যে আবার ৫টি ‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’, ১২৮টি ‘বিপন্ন’ ও ২৬২টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাশাপাশি, ৭০টি প্রজাতিকে ‘প্রায় হুমকির মুখে’ এবং ৭টি প্রজাতিকে ‘আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্তপ্রায়’ হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, একটি প্রজাতিকে ‘বন্য প্রতিবেশে বিলুপ্ত’ ঘোষণা করা হয়েছে।
বর্তমানে রেড লিস্টে ‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া বাল্বোরক্স (bulborox) ও ছোট-বাল্ব অর্কিডের (small-bulb orchids) দেখা মেলে কেবল সুন্দরবনের একটি নির্দিষ্ট এলাকায়। এছাড়া শুধুমাত্র দেশের উত্তরাঞ্চলে, দিনাজপুর জেলার শালবনে (Shorea robusta) টিকে আছে বনখেজুর (dwarf date palm).
‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’র তালিকায় আরো রয়েছে চালমুগরা বা chaulmoogra (Hydnocarpus kurzii). বর্তমানে বান্দরবান, রাঙামাটি, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বনাঞ্চলে অতি বিরল এ উদ্ভিদ অল্পসংখ্যক দেখা যায়।
কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু এলাকায় এবং জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এখনো বাঁশপাতা বা bash pata (Podocarpus neriifolius) উদ্ভিদের দেখা মিললেও, সারা দেশে এ উদ্ভিদ টিকে আছে মাত্র ১১১টি।
নথি অনুযায়ী, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে দুটি অর্কিডের সংখ্যা বৃদ্ধি করে পরবর্তীতে উপকূলীয় ও পাহাড়ি বনের মতো উপযুক্ত স্থানে রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বনখেজুর (dwarf date palm) ছোট আকারের উদ্ভিদ। আকারে ছোট বলে এটি টবেও সহজে চাষ করা যায়। একারণেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত হওয়া এ উদ্ভিদের চারা উৎপাদনে কাজ করছেন গবেষকরা। এসকল চারা দেশের বিভিন্ন জেলার শালবনে রোপণের জন্য উৎপাদিত হচ্ছে।
রেড লিস্টে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বীজ থেকে জন্মানোর ক্ষমতা সীমিত চালমুগরা (Hydnocarpus kurzii) গাছের। তবে টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করে এটি চাষ করা যেতে পারে। তাই এ পদ্ধতিতে চারা তৈরি করে প্রাকৃতিক প্রতিবেশে রোপণের প্রচেষ্টা চলমান।
অন্যদিকে, বাঁশপাতা গাছ নিষ্ফলা এবং এটি নগ্নবীজী উদ্ভিদ। পেন্সিল তৈরিতে ব্যবহৃত এ উদ্ভিদের বীজ উৎপাদনের হারও খুবই সীমিত। তাই বন বিভাগ বাঁশপাতা উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে এর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, “আমরা প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় কাজ করছি। পাঁচটি বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণের পাশাপাশি আমরা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আরও দুটি বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ— গোলা অঞ্জন (Memecylon ovatum Smith) এবং ফিতা চম্পা (Magnolia griffithii) সংগ্রহের চেষ্টা করছি। কারণ, আমাদের বন ও বনের প্রতিবেশ প্রায় একই ধরনের।”
জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে বায়ুমণ্ডল ও মাটির গঠন এবং গুণমান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে উদ্ভিদ। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্য শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ক্ষুদ্র জীবকেও টিকে থাকতে সহায়তা করে। এছাড়া ওষুধ, নির্মাণ সামগ্রী, জৈব জ্বালানি, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রভৃতির কাঁচামাল উদ্ভিদ থেকে আসে। কোনো একটি প্রজাতির উদ্ভিদের বিলুপ্তি এ ধরনের প্রাকৃতিক শৃঙ্খল ভেঙে দিতে পারে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
এ কাজে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান এবং IUCN Bangladesh একসঙ্গে কাজ করছে।
উদ্ভিদের রেড লিস্ট তৈরিতে কাজ করেছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, “অর্কিডের বংশবৃদ্ধির জন্য বাল্ব ব্যবহার করা সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। তবে সময়সাপেক্ষ হলেও টিস্যু কালচার পদ্ধতিই এর জন্য সর্বোত্তম।”
বনখেজুরের বিষয়ে মঙ্গাবেকে অধ্যাপক গাজী মোশারফ হোসেন বলেন, “যেহেতু প্রজাতিটি তার বীজ থেকে বৃদ্ধি পায়, সহজেই এর বংশবৃদ্ধি করা যেতে পারে।”
রেড লিস্ট প্রকল্পের সমন্বয়কারী এ.বি.এম. সারোয়ার আলম বলেন, “আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশ প্রজাতি ‘বিপন্ন অবস্থায়’ রয়েছে। প্রকৃতিতে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রতিটি প্রজাতির উদ্ভিদ সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে চলমান উদ্যোগগুলো এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির আবাসস্থল। এ.বি.এম. সারোয়ার আলম জানান, এসব প্রজাতির মধ্যে মাত্র এক হাজার প্রজাতির অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট প্রজাতির তালিকা করা গেলে সঠিকভাবে রেড লিস্টে এদের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করা যাবে।
উদ্ভিদের পরিপূর্ণ রেড লিস্ট করা সম্ভব হলে, এটি সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ এরইমধ্যে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যসহ ৫৬টি সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে, যা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদ্ভিদের অবস্থা মূল্যায়নের লক্ষ্যে করা এ রেড লিস্টে বিপন্ন প্রজাতির পাশাপাশি ‘ইনভেসিভ’ উদ্ভিদ প্রজাতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এমন ১৭টি প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে এ তালিকায়। এসব উদ্ভিদ নিজেদের সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়ে স্থানীয় প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে, বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে এবং খাদ্যজাল ভেঙে দিতে পারে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো — আসাম গাছ (Chromolaena odorata), আসাম লতা (Mikania scandens), লজ্জাবতী (Mimosa pudica), সানগ্রাস বা ছন (Imperata cylindrica), কাশফুল (Saccharum spontaneum), কচুরিপানা (Eichhornia crassipes) এবং লানটানা (Lantana camara) ।
ব্যানার ইমেজ: বাল্বোরক্স অর্কিড (Bulbophyllum roxburghii) বাংলাদেশে অতিমাত্রায় বিপন্ন। ছবি: Plant.Hunter via Flickr (CC BY-NC-SA 2.0).
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৫ সালের ১২ জুন।




