- সম্প্রতি মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ায়, বাংলাদেশ তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাতির প্রধান আবাসস্থলকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণার পরিকল্পনা করছে।
- এশীয় হাতির আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রায় ২৬৮টি আবাসিক হাতি রয়েছে। অতি বিপন্ন প্রজাতিটি মূলত দেশের দক্ষিণের পাহাড়ি বনাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বের কিছু অংশে বাস করে।
- উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাতিগুলো মূলত অনাবাসিক হাতি। এরা প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আগত। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় এসব হাতি বাংলাদেশে আটকা পড়ে আছে। ফলে সম্প্রতি বেড়েছে মানুষ ও হাতির মধ্যকার সংঘাত।
- বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাতি সংরক্ষণে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে তারা আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে স্বাভাবিক চলাচলের করিডোর দিয়ে এরা অবাধে যাতায়াত করতে পারে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পাহাড়ি বনভূমি থেকে নেমে আসা হাতির পাল বছরের পর বছর ঘুরে বেড়াচ্ছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। খাবারের সন্ধানে ঘুরতে থাকা হাতির পাল নষ্ট করছে জনপদের ফসল, বাড়ি-ঘর। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষের সঙ্গে বন্য হাতির সংঘাত। প্রতি বছরই বাড়ছে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ। তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হওয়ায় সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে— হাতি বিচরণের এলাকাটিকে ‘সুরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করার।
বাংলাদেশ বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে এশীয় হাতির (Elephas maximus indicus) বসবাস।
দেশে বর্তমানে ‘আবাসিক’ বন্য হাতির সংখ্যা ২৬৮। দক্ষিণাঞ্চলের পার্বত্য জেলা এ হাতিগুলোর আবাসস্থল । দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও রয়েছে হাতির চলাচল। তবে এদের অবশ্য ‘আবাসিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কারণ এগুলো ভারতের মেঘালয় থেকে খাবারের খোঁজে আসা হাতি। প্রজাতিটির সংরক্ষণের দিক থেকেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের নাম, যদিও বর্তমানে বাংলাদেশে এ প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে সমস্ত হাতির পাল দেখা যাচ্ছে, সেগুলো মূলত এসেছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে। শীতের মৌসুমে মেঘালয় থেকে হাতির পাল বাংলাদেশে আসে খাবারের সন্ধানে। গ্রীষ্মে এরা ফিরে যায় নিজেদের আবাসস্থলে। বহু বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছিল। বিপত্তি বাঁধে ২০১৯ সালে।
২০১৯ সালে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ওঠার পর থেকে হাতি চলাচলের বহু বছরের পুরনো পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেবারের শীতে খাবারের সন্ধানে পাহাড়ি বনভূমি থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসা কিছু হাতির পাল আর ফিরে যেতে পারেনি। এরা এখন সারা বছর বাংলাদেশেই ঘুরে বেড়ায়, খাবারের খোঁজে মানুষের ফসলের মাঠে ঢুকে পড়ে—আর তখনই বেড়ে যায় হাতি ও মানুষের মধ্যকার বৈরিতা।

ছবি: মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ
এদিকে মানুষ ও বন্য হাতির ক্রমবর্ধমান বৈরিতায় একদিকে যেমন মানুষের জীবন, ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, উল্টোদিকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অতি বিপন্ন এ প্রাণী। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এমন সংঘর্ষে শুধু ২০২১ সালেই মারা গেছে ৩৪টি হাতি। এর আগে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ৫০টি হাতি মারা গেছে।
২০২৫ সালের ১২ মার্চ এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিবশে বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল ‘মঙ্গাবে’ (Mongabay)। প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মানুষ ও হাতির মধ্যকার চলমান সংকটের বিস্তারিত বর্ণনা। এরপর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় (MoEFCC) থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল অঞ্চলটি পরিদর্শন করেন। ২৬ মে, মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নিজেও সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
এ সময় তিনি বলেন, “আমি নিজে গিয়ে হাতিদের চলাচল, মানুষের ক্ষয়ক্ষতি আর বনভূমির অবস্থা দেখে এসেছি। প্রাথমিকভাবে এলাকাটিকে সুরক্ষিত ঘোষণা করার প্রক্রিয়া চলছে।”
এছাড়া, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও জানান পরিবেশ উপদেষ্টা।
তবে সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলটিকে ‘সুরক্ষিত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করার উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও অঞ্চলটি বসতবাড়ি ও ফসলি জমিতে পরিপূর্ণ হওয়ায় বাস্তবে এটি কার্যকর করা কঠিন হবে বলে মনে করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ।
তিনি মঙ্গাবেকে বলেন, “উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাতির যে বিচরণভূমি রয়েছে তা মূলত শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার সীমান্তঘেঁষা প্রায় ৪১ কিলোমিটার (২৫ দশমিক ৪ মাইল) দীর্ঘ একটি অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। সীমান্তের ভেতরে যদি আরো প্রায় ৫ কিলোমিটার (৩ দশমিক ১ মাইল) এলাকা ধরি, তাহলে মোট অঞ্চলটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার। বিশাল এ এলাকার বেশিরভাগ জায়গাতেই এখন মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে এবং বাকি অংশ চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।”
এ অঞ্চল একসময় ঘন শালবনের (Shorea robusta) জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন বনের অনেকটাই উজাড় হয়ে গেছে। সেই বন আর নেই, কিন্তু হাতিরা আছে—ফলে এরা বাধ্য হয়ে ফসলি জমিতে চলে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে সংঘাত এড়াতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার তাগিদ দেন ড. ফিরোজ। তিনি বলেন, “এখনই একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার, যেখানে পর্যাপ্ত Elephant Response Team (ERT) নিয়োজিত থাকবে।”
Elephant Response Team সাধারণত স্থানীয় মানুষদের নিয়ে গঠিত হয়। দলটি বিভিন্ন উপায়ে হাতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন হাতির পালের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা এবং হাতি সংরক্ষণ ও বন্য প্রাণীদের সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
IUCN Bangladesh এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ.বি.এম সারোয়ার আলম এ অঞ্চলে ফসল চাষের ধরন পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যেহেতু বেশিরভাগ সময়ই হাতির পাল তাদের খাবারের জন্য ধান এবং সবজি খামার ধ্বংস করে, তাই কৃষকরা কাঁচা মরিচের মতো বিকল্প ফসল চাষ করতে পারেন যা হাতিরা খেতে পছন্দ করে না।”
তবে অধ্যাপক ড. ফিরোজ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চারটি ‘হাতি করিডোর’ খোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, যাতে হাতির পাল তাদের নিয়মিত চলাচল চালিয়ে যেতে পারে। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদে অঞ্চলটি মানুষ এবং হাতি উভয়ের জন্যই প্রতিকূল স্থানে পরিণত হবে।

ছবি: মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ
এলাকাটিকে সুরক্ষিত ঘোষণা করা এবং তাদের সংরক্ষণের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি উভয় বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারত ২০২০ সালে আন্তঃসীমান্ত হাতির সংঘাত এবং তাদের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে। তবে প্রটোকল পরিচালনার শর্তাবলী চূড়ান্ত করার কাজ এখনও চলমান।
প্রোটোকল ছাড়াও, ২০২৫ সালে ১৩টি এশীয় হাতি (Elephas maximus) পরিসরের দেশ কর্তৃক গৃহীত সিয়াম রিপ ঘোষণাপত্রটি সংকট সমাধানের জন্য একটি ভালো হাতিয়ার হবে বলে জানিয়েছেন ড. ফিরোজ। ঘোষণাপত্র অনুসারে, হাতি পরিসরের দেশগুলো দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিকভাবে হাতি সংরক্ষণের জন্য আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা বৃদ্ধি করার কথা রয়েছে। তথ্যমতে, এই ১৩টি দেশের একত্রে বন্য হাতির সংখ্যা ৫০ হাজারের কম।
বাংলাদেশে এশীয় হাতির অবস্থা এবং সংরক্ষণ
IUCN Bangladesh –এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪৪টি বন রেঞ্জে হাতির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে। এই বনাঞ্চলগুলো সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৫১৮ বর্গকিলোমিটার (৫৮৬ বর্গমাইল) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এছাড়া বাংলাদেশে ১২টি ‘হাতি করিডোর’ রয়েছে।
হাতির চলাচলের পথকে মূলত দুইভাবে ভাগ করা যায়—প্রতিদিন খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য যেসব পথ হাতিরা ব্যবহার করে সেগুলো হল রুট। আর এক বনাঞ্চল থেকে আরেকটিতে যাওয়ার জন্য যেসব সংকীর্ণ এলাকা দিয়ে হাতির পাল যাতায়াত করে সেগুলোকে বলা হয় করিডোর।
‘Status of the Asian Elephant in Bangladesh’ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে—বিশেষ করে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারে—হাতির বসবাস সবচেয়ে বেশি।
এই বনাঞ্চলে যেসব হাতি নিয়মিত বাস করে, তাদের ‘রেসিডেন্ট’ বা ‘আবাসিক’ হাতি বলা হয়। অন্যদিকে যেসব হাতি প্রতিবেশী দেশ ভারত বা মিয়ানমার থেকে নিয়মিত সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসে আবার ফিরে যায়, তাদের ‘নন-রেসিডেন্ট’ তথা ‘অনাবাসিক’ হাতি বলা হয়।
বাংলাদেশ বন বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মানুষ-হাতি সংঘাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫০টি হাতি। এর মধ্যে ২০২১ সালেই সবচেয়ে বেশি, মোট ৩৪টি হাতির মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালে, সরকার দেশব্যাপী হাতি সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ১০ বছর মেয়াদী Elephant Conservation Action Plan তৈরি করে।
এর পাশাপাশি, Sustainable Forests & Livelihoods (SUFAL) নামক একটি প্রকল্পের আওতায়, বন বিভাগ, IUCN Bangladesh এর মতো এনজিওগুলোর সাথে সংঘাতপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করেছে। এর অংশ হিসেবে মানুষ-হাতি সংঘাত প্রশমনের জন্য সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে ERT গঠন করেছে।
এছাড়া মানবজীবন ও সম্পদের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণীর আক্রমণে প্রাণহানিসহ ঘরবাড়ি এবং ফসলের ক্ষেতের মতো সম্পদ হারানো পরিবারের জন্য একটি ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ চালু করে বাংলাদেশ বন বিভাগ। পরবর্তীতে ২০২১ সালে, অতিরিক্ত সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজটি আপডেট করা হয়।
দেশে এরইমধ্যে জাতীয় উদ্যান এবং অভয়ারণ্যসহ ৫৬টি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, যা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ব্যানার ইমেজ: উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের কৃষিজমিতে বাচ্চাসহ একটি মা হাতি। ছবি: মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গাবে গ্লোবাল-এ – এ, ২০২৫ সালের ১৮ জুন।