- বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং এক প্রজাতির গলদা চিংড়ি পাওয়া যায় সুন্দরবনে।
- ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে ম্যানগ্রোভ বনের কাছাকাছি বসবাসকারী, ১৭ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য মাছ এবং কাঁকড়াসহ বিবিধ বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল।
- তাদের মধ্যে কিছু জেলে স্বল্প সময়ে ও সহজে মাছ ধরতে, বিষ প্রয়োগ করেন। এমনকি নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতেও তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকেন না। মাছে বিষ প্রয়োগ করায় একদিকে যেমন বনের প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, সেই মাছ খেয়ে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
- বন ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করা এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে, এই ভয়াবহ প্রথা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে বন বিভাগ এতে ব্যর্থ হওয়ায়, এখনও বিষ দিয়ে মাছ ধরার ঘটনা অহরহই ঘটছে সুন্দরবনে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য মানুষের জীবিকা। প্রাকৃতিকভাবে এই বনে মাছ, কাঁকড়া, মধু ও কাঠ পাওয়া যায়। সম্পদ আহরণ ও বনের স্বাস্থ্যের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে, বাংলাদেশ বন বিভাগ প্রতি বছর বনের নির্দিষ্ট এলাকায় ফি প্রদানের বিনিময়ে সম্পদ আহরণের অনুমতি দেয়। তবে জুন, জুলাই ও আগস্ট—এই তিন মাস বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হওয়ায় সম্পদ আহরণ বন্ধ থাকে।
নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ থাকার পরও কিছু জেলে সারা বছরই মাছ ধরেন। স্বল্প সময়ে ও সহজে মাছ ধরতে বিষও ব্যবহার করেন তারা। এমনকি নিষেধাজ্ঞার সময়গুলোতেও তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকেন না। মাছে বিষ প্রয়োগ করায় একদিকে যেমন বনের প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, সেই মাছ খেয়ে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ছে।
বন ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করা এক রিটের প্রেক্ষিতে রায় দেয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট। সেই রায়ে, এই ভয়াবহ প্রথা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে বন বিভাগ আদালতের নির্দেশ পুরোপুরি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এখনও বিষ দিয়ে মাছ ধরার ঘটনা অহরহই ঘটছে সুন্দরবনে।
খুলনা জেলার বাসিন্দা আব্দুল আলীম এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, “জেলেরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে ঢোকে। মাছ ধরার জন্য তারা এক ধরনের সিরাপজাতীয় বিষ ব্যবহার করেন। এই বিষ এক ফোঁটাও জলাশয়ে পড়লে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণী তীরে উঠে আসে।”

তিনি আরও বলেন, “এই প্রক্রিয়ায় খুব অল্প সময়েই জেলেরা অনেক মাছ ধরতে পারেন। এজন্য সাধারণত তারা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার করে, যাতে তারা কাজ শেষে দ্রুত পালিয়ে যেতে পারে।”
বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে অবস্থান সুন্দরবনের। বাংলাদেশে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আছে এ বনাঞ্চল। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং এক প্রজাতির গলদা চিংড়ি রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ও মৎস্য বিভাগের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, “বিষ দিয়ে মাছ ধরা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর হুমকি। এতে বনের সব প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার আইন করে এটি বন্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ নিয়ম মানেনি। শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী এ অসাধু কাজের সঙ্গে যুক্ত, যাদের থামানো যাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
বাংলাদেশ বন বিভাগের খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমারও বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি অস্বীকার করছি না, তবে আমাদের প্রচেষ্টাও বিবেচনা করা উচিত। এ বছরের মার্চ মাসেই আমরা বিষ ব্যবহার করে মাছ ধরার সময় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি এবং বন আইনে মামলা দিয়েছি। এই ভয়াবহ প্রথা বন্ধে আমাদের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।”

আব্দুল আলীম জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিষ দিয়ে ধরা মাছ বনেই শুকিয়ে শুঁটকি বানানো হয়। কারণ, স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীরা সাধারণত বিষ প্রয়োগে ধরা মাছ কিনতে চান না। আবার কিছু মাছ শহরে পাঠানো হয়। শহরের মানুষ জানতেই পারে না, মাছগুলো কোথা থেকে এসেছে।
এসব মাছ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করে। Johns Hopkins Medicine এর তথ্যমতে, এসব মাছ খেলে মানুষের পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র এবং হৃদযন্ত্রে নানা ধরনের রোগ হতে পারে। এতে প্রাথমিকভাবে বমি, বমিভাব, পাতলা পায়খানা ও মাথাব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, “এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আপনি না জেনে এসব মাছ খেলে, এটি ধীরে ধীরে আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ধরনের রোগও হতে পারে।”

অবৈধ মাছ ধরার কারণ
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের সীমানার কাছাকাছি ৮টি উপজেলার ৭৬টি গ্রামে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বসবাস করে। বন যত কাছে, মানুষ তত বেশি এর সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বনসীমানার দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকা প্রায় ৭৮ শতাংশ পরিবার, জীবিকার জন্য সরাসরি সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে।
এ অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর প্রবাহ বদলে যাওয়ার কারণে ক্রমশ কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন স্থানীয়রা। ফলে তাদের অনেকেরই প্রধান জীবিকা হয়ে উঠেছে, সুন্দরবন থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ।
গবেষণায় আরও বলা হয়, এখানকার মানুষ মৌসুমভেদে বিভিন্ন সম্পদের ওপর নির্ভর করে। তবে জীবিকার অন্যতম উৎস, মাছ ধরা। পাশাপাশি, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণেও অনেকে নিয়ম ভেঙে অবৈধভাবে মাছ ধরতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যানার ছবি: সুন্দরবনের মাছ ধরার নৌকা। ছবি: অমিত রাওয়াত via Flickr (CC BY-NC-SA 2.0).
সাইটেশন
Siddique, M. R., Hossain, M., & Rashid, A. Z. (2023). The dilemma of prioritizing conservation over livelihoods: Assessing the impact of fishing restriction to the fishermen of the Sundarbans. Trees, Forests and People, 11, 100366. https://doi.org/10.1016/j.tfp.2022.100366
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে গ্লোবাল – এ, ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর।