- ২০২৩ সালের অক্টোবরে সিকিমে শুরু হওয়া বন্যায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকা বালি ও পলিতে ঢেকে যায়। ফলে এই অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
- সেইসঙ্গে ভূমি অধিকার এবং জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এবং জেলেরা সরকারি সাহায্য পেতেও অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
- অক্টোবরের বন্যায় একটি অস্থায়ী বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ভবিষ্যতে বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব রোধে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বাসিন্দা ৫৪ বছর বয়সী কৃষক গোপাল সরকার। গত শীতে সবজি চাষ করতে গিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি। অক্টোবরের বন্যায় তার এক হেক্টর জমি ৪ থেকে ৫ ফুট পুরু বালি আর পলির স্তরে ঢেকে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় জমির উৎপাদনশক্তি।
জলপাইগুড়ির মাল মহকুমার গজলডোবা ব্যারেজ অঞ্চলের কৃষক তিনি। তিনি মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-কে বলেন, “প্রতি বছর এই মৌসুমে আমি আলু, মটরশুঁটি, লাউ, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও অন্যান্য সবজি চাষ করি। বাজারে এগুলোর চাহিদা অনেক কিন্তু এ বছর প্রায় কিছুই ফলাতে পারিনি। পুরো ক্ষেত ফাঁকা আর অনুর্বর পড়ে আছে।”
২০২৩ সালের অক্টোবরে তিস্তা নদীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু কৃষকের একজন গোপাল। এই বন্যা সিকিম থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা (১২ নম্বর গ্রাম) থেকে চাপাডাঙ্গা পর্যন্ত, প্রায় ২২ কিলোমিটার জুড়ে থাকা তিস্তা তীরের ফসলি জমি ধ্বংস করে দেয়। তখন বন্যার পানি প্রচুর বালি ও পলি বয়ে আনে, ফলে গজলডোবা বাঁধের নিচের দিকের গ্রামগুলোর জমির ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে, হিমালয়ের সিকিম রাজ্যের লোনাক হ্রদ ভেঙে তিস্তা নদীতে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা নেমে আসে। এরপর চুংথাং বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেওয়ায়, সিকিমে ক্ষতি আরও বাড়ে এবং উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়।

গজলডোবা তিস্তা বাঁধের পাশে অবস্থিত এই অববাহিকা অঞ্চলের স্থানীয়রা জানান, এখানে মূলত পাশের জেলা থেকে আসা অভিবাসীরা বসবাস করেন। তারা শাকসবজি আর ধান চাষ করেন। মৌসুমি ফসল হিসেবে আলু, লাউ, শিম আর মটরশুঁটি খুব পরিচিত। গ্রীষ্মকালে এখানে তরমুজ ও বাঙ্গি চাষও হয়। কৃষিকাজ আর মাছ ধরাই এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা।
গোপাল সরকার ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে কাজের সন্ধানে কোচবিহার থেকে গজলডোবা গ্রামে এসেছিলেন। তখন তিস্তা বাঁধ তৈরি হচ্ছিল। গোপালের মতো আরও বেশ কয়েকজন এখানে এসে বসতি গড়েছিলেন। তারা সবাই এখন বন্যা পরবর্তী নানান সমস্যার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রায় ২০০ জন কৃষকের মালিকানাধীন, একসময়ের প্রায় ২০২ হেক্টর উর্বর ক্ষেত এখন পুরু ধূসর পলির নিচে চাপা পড়ে আছে বলে জানান, গোপাল সরকার।
এলাকাটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত আবার বিকল্প জীবিকার পথও নেই। তাই জমি আবার চাষের উপযোগী করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু কৃষক। তবে বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ হচ্ছে তাদের সকল প্রয়াস।
গোপাল সরকার জানান, তিনি একসময় প্রচুর মটর চাষ করতেন। এবার সেই জমিতে ফসল ওঠেনি। প্রচুর সার দিলেও গাছ ভালোভাবে বাড়েনি। এতে বোঝা যাচ্ছে, জমিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নেই।

একই গ্রামের বাসিন্দা ৫০ বছরের মিনু সরকার এবং ২৪ বছরের অজয় দাসও ধান চাষ আর মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন। তারাও জীবিকার পথ হারিয়েছেন। মিনু সরকার বলেন, “আমার প্রায় দুই হেক্টর জমিতে ধান ছিল। আমি ধার নিয়ে চাষ করেছিলাম, ভেবেছিলাম বিক্রি করে ঋণ শোধ করব। তা হয়নি। মাঠে একটা পুকুর ছিল,সেখানে মাছ ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। পলিতে পুরো পুকুর ভরে গেছে। সামনে আমার ছেলের বিয়ে, এদিকে আমাদের আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ।”
কৃষিক্ষেত্র কমে আসায় তরুণ কৃষকেরা কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। এদের একজন ১২ নম্বর গজলডোবার বাসিন্দা, ২৮ বছর বয়সী পার্থ সরকার। তার এখানেই জন্ম এবং বন্যার আগে তিনি চাষের কাজই করতেন। এখন তিনি কেরালায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ছোট থেকেই মাঠে কাজ করতাম, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি দেখে বাইরে কাজ খুঁজতে হচ্ছে। আমাদের দুই হেক্টর জমি ছিল, সবটাই শেষ হয়ে গেছে।”

চাপাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান মনোরঞ্জন বিশ্বাস জানান, আগে প্রতি পাঁচ-দশ বছরে একবার বন্যায় জমিতে পলি জমে জমি উর্বর হয়ে যেত। ফলে ফসলও ভালো হতো।
তবে এবারের বন্যা অন্যরকম ছিল। Society for Direct Initiative for Social and Health Action (DISHA) এর উত্তরবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম (UMF)-এর তত্ত্বাবধায়ক কঙ্কন লাহিড়ী জানান, আকস্মিক বন্যায় উত্তর সিকিমের সেনা শিবির থেকে গোলাবারুদভেসে আসে। সেনা ক্যাম্প থেকে আসা মর্টার শেল পানির সঙ্গে ভেসে চর আর নদীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।”
মৎস্যক্ষেত্রের ক্ষতি
এই বন্যায় তিস্তার জেলে পরিবারগুলোও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কঙ্কন লাহিড়ী বলেন, “জল এখনও দূষিত, মাছ নেই। অনেকেই অন্যত্র কাজ খুঁজছেন বা বাইরে থেকে মাছ কিনে আনছেন। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে সম্পূর্ণ স্থবিরতার পর, জানুয়ারিতে অল্পস্বল্প মাছ ফিরতে শুরু করেছে।”

৬৫ বছর বয়সী শচীন দাস জানান, অজানা রাসায়নিকের কারণে নদীর সব মাছ মরে গেছে। বন্যায় গ্যাস সিলিন্ডার আর কাঠ ভেসে এসে জলকে আরও দূষিত করেছে।
UMF-এর শাখা সম্পাদক বাবলু দাস বলেন, “এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৪-৫ বছর সময় লাগবে।”
কঙ্কন লাহিড়ী জানান, তারা সরকারি সাহায্য আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনার’ ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এতে সরকার ৫ হাজার রুপি এবং ৩০ কেজি চাল দেওয়ার কথা বলেছে। স্থানীয় সরকার অফিসে আবেদন করা হয়েছে এবং জেলা পরিষদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এছাড়া, গত অক্টোবরে তারা জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত কুমার রায়কে চিঠি লিখে প্রান্তিক জেলেদের সমস্যার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।
বাঁধ নির্মাণের দাবি
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বন্যার পর তারা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাননি। কারণ প্রায় ৬০ শতাংশ জমিই খাস জমি, যেগুলো সরকারি মালিকানাধীন। ফলে কৃষকদের সেই জমিতে কোনো অধিকার নেই। যেকারণে সরকারি প্রকল্প থেকেও তারা সাহায্য পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ভুট্টার বীজ দেওয়া হয়েছে। তবে জমি পুনরুদ্ধার বা মেরামতের জন্য কিছুই করেনি সরকার।
এ কারণে গ্রামবাসীদের দাবি, তিস্তার তীরে নতুন বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এতে তাদের জমি ও ঘরবাড়ি রক্ষা পাবে এবং তারা আবার কৃষিকাজে ফিরতে পারবেন।

গ্রামবাসীরা জানান, আগে বাঁধের পাশে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী বাঁধ ছিল, যাকে ‘বস্তার বাঁধ’ বলা হতো। প্রায় পাঁচ বছর আগে, Mahatma Gandhi National Rural Employment Guarantee Scheme (MNREGS) প্রকল্পের আওতায় স্থানীয়রা এটি তৈরি করেছিলেন। এবারের বন্যায় সেটি ভেঙে গেছে।
বাবলু দাস বলেন, “বাঁধ না থাকলে আমাদের গ্রাম আবার ডুবে যাবে। আমাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে।”
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরেজমিনে এলাকায় গিয়েছেন এবং তদন্ত করেছেন। কৃষকদের সমস্যা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। ইমেইলের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের কাছে মোট ক্ষতির পরিমাণ ও ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনা জানতে চেয়েছিল, মঙ্গাবে ইন্ডিয়া। তবে এ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ব্যানার ছবি: ২০২৩ সালের অক্টোবরে পার্শ্ববর্তী রাজ্য সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা নদীর তীরবর্তী জলপাইগুড়ি জেলার ক্ষতিগ্রস্ত অংশে, বন্যার পর ৪ থেকে ৫ ফুট বালি ও পলিতে ঢাকা ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন গোপাল সরকার।
নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, মঙ্গাবে ইন্ডিয়া-তে, ২০২৪ সালের ১ মার্চ।